পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে २®ॐ বিধিবিধান সব ভেসে যাবে, সব ভেসে যাবে। রাজা অামার, দেবতা আমার, তুমি আমার মধ্যে যে কী দেখেছ তা জানি নে, কিন্তু আমি আমার এই হৃংপদ্মের উপরে তোমার বিশ্বরূপ যে দেখলুম। তার কাছে আমি কোথায় আছি । সর্বনাশ গো সর্বনাশ, কী তার প্রচণ্ড শক্তি ৷ যতক্ষণ না সে আমাকে সম্পূর্ণ মেরে ফেলবে ততক্ষণ আমি তো আর বঁচি নে, আমি তো আর পারি নে, আমার যে বুক ফেটে গেল । বলতে বলতে সে চৌকির উপর থেকে মাটির উপর পড়ে গিয়ে আমার দুই পা জড়িয়ে ধরলে । তার পরে ফুলে ফুলে কাল্লা কান্না কান্না । এই তো হিপনটিজম । এই শক্তিই পৃথিবী জয় করবার শক্তি। কোনে উপায় নয়, উপকরণ নয়, এই সম্মোহন । কে বলে সত্যমেব জয়তে। জয় হবে মোহের । বাঙালি সে-কথা বুঝেছিল, তাই বাঙালি এনেছিল দশভূজার পূজা, বাঙালি গড়েছিল সিংহবাহিনীর মূতি। সেই বাঙালি আবার আজ মৃতি গড়বে, জয় করবে বিশ্ব কেবল সন্মোহনে—বন্দেমাতরং । আস্তে আস্তে হাতে ধরে বিমলাকে চৌকির উপরে উঠিয়ে বসালুম। এই উত্তেজনার পরে অবসাদ আসবার আগেই তাকে বললুম, বাংলাদেশে মায়ের পূজা প্রতিষ্ঠা করবার ভার তিনি আমার উপরেই দিয়েছেন, কিন্তু আমি যে গরিব । বিমলার মুখ তখনো লাল, চোখ তখনো বাম্পে ঢাকা ; সে গদগদ কণ্ঠে বললে, তুমি গরিব কিসের ? যার যা-কিছু আছে সব যে তোমারই। কিসের জন্যে বাক্স ভরে আমার গয়না জমে রয়েছে ? আমার সমস্ত সোনা-মানিক তোমার পুজোয় নাও না কেড়ে, আমার কিছুই দরকার নেই। এর আগে আর-একবার বিমল গয়না দিতে চেয়েছিল—আমার কিছুতে বাধে না, ওইখানটায় বাধল। সংকোচটা কিসের আমি ভেবে দেখেছি। চিরদিন পুরুষই মেয়েকে গয়না দিয়ে সাজিয়ে এসেছে, মেয়ের হাত থেকে গয়না নিতে গেলে কেমন যেন পৌরুষে ঘ। পড়ে । কিন্তু এখানে নিজেকে ভোলা চাই । আমি নিচ্ছি নে। এ মায়ের পূজা, সমস্তই সেই পূজায় ঢালব। এমন সমারোহ করে করতে হবে যে তেমন পূজা এদেশে কেউ কোনো দিন দেখে নি। চিরদিনের মতো নূতন বাংলার ইতিহাসের মর্মের মাঝখানে এই পূজা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এই পূজাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠদানরূপে দেশকে দিয়ে যাব। দেবতার সাধনা করে দেশের মুখেরা, দেবতার স্বষ্টি করবে সন্দীপ ।