পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ఇ\\ు রবীন্দ্র-রচনাবলী হাওয়ার সমস্ত ইশারা একেবারে গায়ের উপরে এসে পড়ে, আলো-অন্ধকারের সমস্ত মিড় বুকের ভিতরে বেজে ওঠে। দিনের আলো যখন প্রখর থাকে তখন সংসার তার অসংখ্য কাজ নিয়ে চারদিকে ভিড় করে দাড়ায়, তখন মনে হয় জীবনে এ ছাড়া আর কিছুরই দরকার নেই। কিন্তু যখন আকাশ মান হয়ে আসে, যখন স্বর্গের জানলা থেকে মর্ত্যের উপর পর্দ। নেমে আসতে থাকে, তখন আমার মন বলে, জগতে সন্ধ্যা আসে সমস্ত সংসারটাকে আড়াল করবার জন্যেই,—এখন কেবল একের সঙ্গ অনন্ত অন্ধকারকে ভরে তুলবে, এইটেই ছিল জলস্থল-আকাশের একমাত্র মন্ত্রণা । দিনের বেলা যে-প্রাণ অনেকের মধ্যে বিকশিত হয়ে উঠবে সন্ধ্যার সময় সেই প্রাণই একের মধ্যে মুদে আসবে, আলো-অন্ধকারের ভিতরকার অর্থ টাই ছিল এই । আমি সেটাকে অস্বীকার করে কঠিন হয়ে থাকতে পারি নে,—তাই সন্ধ্যাটি যেই জগতের উপর প্রেয়সীর কালো চোখের তারার মতো অনিমেষ হয়ে ওঠে তখন আমার সমস্ত দেহমন বলতে থাকে,—সত্য নয়, এ-কথা কখনোই সত্য নয় যে, কেবলমাত্র কাজই মামুষের আদি অস্ত ;–মানুষ একান্তই মজুর নয়, হ’ক না সে সত্যের মজুরি, ধর্মের মজুরি ;–সেই তারার আলোয় ছুটি-পাওয়া কাজের-বাইরেকার মানুষ সেই অন্ধকারের অমৃতে ডুবে মরবার মানুষটিকে তুই কি চিরদিনের মতো হারালি, নিখিলেশ ? সমস্ত সংসারের অসংখ্যতাও যে-জায়গায় মানুষকে লেশমাত্র সঙ্গ দিতে পারে না, সেইখানে যে-লোক একলা হয়েছে সে কী ভয়ানক একলা । সেদিন বিকেলবেলাটা ঠিক যখন সন্ধ্যার মোহানাটিতে এসে পৌছেছে, তখন আমার কাজ ছিল না, কাজে মনও ছিল না, মাস্টারমশায়ও ছিলেন না, শূন্ত বুকটা যখন আকাশে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছিল তখন আমি বাড়ি-ভিতরের বাগানে গেলুম। আমার চন্দ্রমল্লিকা ফুলের বড়ে শখ । আমি টবে করে নানা রঙের চন্দ্রমল্লিকা বাগানে সাজিয়েছিলুম, যখন সমস্ত গাছ ভরে ফুল ফুটে উঠত তখন মনে হত সবুজ সমুদ্রে ঢেউ লেগে রঙের ফেনা উঠেছে। কিছুকাল আমি বাগানে যাই নি, আজ মনে মনে একটু হেসে বললুম, আমার বিরহিণী চন্দ্রমল্লিকার বিরহ ঘুচিয়ে আসি গে। বাগানে যখন ঢুকলুম তখন কৃষ্ণ-প্রতিপদের চাদটি ঠিক আমাদের পাচিলের উপরটিতে এসে মুখ বাড়িয়েছে। পাচিলের তলাটিতে নিবিড় ছায়া—তারই উপর দিয়ে বঁাকা হয়ে চাদের আলো বাগানের পশ্চিমদিকে এসে পড়েছে। ঠিক আমার মনে হল চাদ যেন হঠাৎ পিছন দিক থেকে এসে অন্ধকারের চোখ টিপে ধরে মুচকে হাসছে ।