পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে ২৭৫ সেই অপদেবতা একদিন রাঙা মশাল হাতে করে এসে আমাকে বললে, আমিই তোমার দেশ, আমিই তোমার সন্দীপ, আমার চেয়ে বড়ো তোমার আর কিছুই নেই—বন্দেমাতরং । আমি হাত জোড় করে বললুম, তুমিই আমার ধর্ম, তুমিই আমার স্বর্গ, আমার যা-কিছু আছে সব তোমার প্রেমে ভাসিয়ে দেব—বন্দেমাতরং । পাচ হাজার চাই ? আচ্ছ। পাচ হাজারই নিয়ে যাব। কালই চাই ? আচ্ছা কালই পাবে ! কলঙ্কে দুঃসাহসে ওই পাচ হাজার টাকার দান মদের মতো ফেনিয়ে উঠবে—তার পরে মাতালের উৎসব,—অচলা পৃথিবী পায়ের তলায় টলমল করতে থাকবে, চোখের উপর আগুন ছুটবে, কানের ভিতর ঝড়ের গর্জন জাগবে, সামনে কী আছে কী নেই তা বুঝতেই পারব না,—তার পরে টলতে টলতে পড়ব গিয়ে মরণের মধ্যে—সমস্ত আগুন এক নিমিষে নিবে যাবে, সমস্ত ছাই হাওয়ায় উড়বে,—কিছুই আর বাকি থাকবে না । টাকা কোথায় পাওয়া যেতে পারে সে-কথা এর আগে কোনো মতেই ভেবে পাচ্ছিলুম না। সেদিন তীব্র উত্তেজনার আলোতে এই টাকাটা হঠাৎ চোখের সামনে প্রত্যক্ষ দেখতে পেলুম। * : ফি-বছর আমার স্বামী পূজোর সময় তার বড়ো ভাজ আর মেজো ভাজকে তিন হাজার টাকা করে প্রণামী দিয়ে থাকেন। সেই টাকা বছরে বছরে তাদের নামে ব্যাঙ্কে জমা হয়ে স্বদে বাড়ছে । এবারেও নিয়মমতো প্রণামী দেওয়া হয়েছে, কিন্তু জানি টাকাটা এখনো ব্যাঙ্কে পাঠানো হয় নি। কোথায় আছে তাও আমার জানা । আমাদের শোবার ঘরের সংলগ্ন কাপড়-ছাড়বার ছোটো কুঠরির কোণে লোহার সিন্দুক আছে, তারই মধ্যে টাকাটা তোলা হয়েছে। ফি-বছরে এই টাকা নিয়ে আমার স্বামী কলকাতার ব্যাঙ্কে জমা দিতে যান এবারে তার আর যাওয়া হল না । এই জন্তেই তো দৈবকে মানি। ওই টাকা দেশ নেবেন বলেই আটক আছে–এ টাকা ব্যাঙ্কে নিয়ে যায় সাধ্য কার ? আর এই টাক। আমি ন নিই-এমন সাধ্যই বা আমার কই ? প্রলয়ংকরী খপর বাড়িয়ে দিয়েছেন—বলছেন আমি ক্ষুধিত, আমাকে দে,—আমি আমার বুকের রক্ত দিলুম, ওই পাঁচ হাজার টাকায়। মাগে, এই টাকা যার গেল তার সামান্তই ক্ষতি হবে—কিন্তু আমাকে এবার তুমি একেবারে ফতুর করে নিলে । এর আগে কতদিন বড়োরানী-মেজোরানীকে আমি মনে মনে চোর বলেছি— আমার বিশ্বাসপরায়ণ স্বামীকে ভুলিয়ে তার ফাকি দিয়ে কেবল টাকা নিচ্ছেন, এই ছিল আমার নালিশ। তাদের স্বামীদের মৃত্যুর পরে অনেক সরকারি জিনিসপত্র তারা