পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ՀԳՆ রবীন্দ্র-রচনাবলী লুকিয়ে সরিয়েছেন, এ-কথা অনেকবার স্বামীকে বলেছি। তিনি তার কোনো জবাব না করে চুপ করে থাকতেন। তখন আমার রাগ হত, আমি বলতুম, দান করতে হয় হাতে তুলে দান করে, কিন্তু চুরি করতে দেবে কেন ? বিধাতা সেদিন আমার এই নালিশ শুনে মুচকে হেসেছিলেন—আজ আমি আমার স্বামীর সিন্দুক থেকে ওই বড়োরানীর মেজোরানীর টাকা চুরি করতে চলেছি। রাত্রে আমার স্বামী সেই ঘরেই তার জামাকাপড় ছাড়েন, সেই জামার পকেটেই র্তার চাবি থাকে। সেই চাৰি বের করে নিয়ে লোহার সিন্দুক খুললুম। অল্প যে একটু শব্দ হল, মনে হল সমস্ত পৃথিবী যেন জেগে উঠল। হঠাৎ একটা শীতে আমার হাতপা হিম হয়ে বুকের মধ্যে ঠকঠক করে কাপতে থাকল । লোহার সিন্দুকের মধ্যে একটা টানা দেরাজ আছে। সেইটে খুলে দেখলুম নোট নেই, কাগজের মোড়কে ভাগ করা গিনি সাজানো । প্রতি মোড়কে কত ॥গনি আছে, আমার কত দরকার, সে তখন হিসেব করবার সময় নয়। কুড়িটি মোড়ক ছিল, সব কট। নিয়েই আমার আঁচলে বাধলম । কম ভারী নয়। চুরির ভারে আমার মন যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হয়তো নোটের তাড়া হলে সেটাকে এত বেশি চুরি বলে মনে হত না । এ যে সব সোনা । সেই রাত্রে নিজের ঘরে যখন চোর হয়ে ঢুকতে হল তখন থেকে এ-ঘর আমার আর আপন রইল না। এ-ঘরে আমার কতবড়ো অধিকার—চুরি করে সব খোয়ালুম। মনে মনে জপতে লাগলুম, বন্দেমাতরং, বন্দেমাতরং । দেশ, আমার দেশ, আমার সোনার দেশ । সব সোন। সেই দেশের সোনা, এ আর কারও নয়। কিন্তু রাত্রের অন্ধকারে মন যে দুর্বল হয়ে থাকে স্বামী পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছিলেন, চোখ বুজে তার ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেলুম—অন্তঃপুরের খোলা ছাদের উপর গিয়ে সেই আঁচলে-বাধা চুরির উপর বুক দিয়ে মাটিতে পড়ে রইলুম—সেই মোড়কগুলো বুকে বাজতে লাগল। নিস্তন্ধ রাত্রি আমার শিয়রের কাছে তর্জনী তুলে রইল । ঘরকে তো আমি দেশ থেকে স্বতন্ত্র করে দেখতে পারলুম না। আজ ঘরকে লুটেছি, দেশকেই লুটেছি—এই পাপে একই সঙ্গে ঘর আমার ঘর রইল না, দেশও হয়ে গেল পর। আমি যদি ভিক্ষে করে দেশের সেবা করতুম, এবং সেই সেৰা সম্পূর্ণ না করেও মরে যে তুম, তবে সেই অসমাপ্ত সেবাই হত পূজা, দেবতা তা গ্রহণ করতেন । কিন্তু চুরি তো পূজা নয়—এ-জিনিস কেমন করে দেশের হাতে তুলে দেব। চোরাই মালে দেশের ভরা ডোবাতে বসলুম গো । নিজে মরতে বসেছি কিন্তু দেশকে অঁাকড়ে ধরে তাকে স্বদ্ধ কেন অশুচি করি।