পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে Oe? নটা বাজল। আমার কেমন বোধ হচ্ছে, অমূল্য বিপদে পড়েছে, ওকে পুলিসে ধরেছে । আমার গয়নার বাক্স নিয়ে থানায় গোলমাল পড়ে গেছে—কার বাক্স ও কোথা থেকে পেলে তার জবাব তো শেষ কালে আমাকেই দিতে হবে, সমস্ত পৃথিবীর লোকের সামনে কী জবাবটা দেব ? মেজোরানী, এতকাল তোমাকে বড়ো অবজ্ঞাই করেছি। আজ তোমার দিন এল। তুমি আজ সমস্ত পৃথিবীর রূপ ধরে শোধ তুলবে। হে ভগবান, এইবার আমাকে বাচাও—আমার সমস্ত অহংকার ভাসিয়ে দিয়ে মেজোরানীর পায়ের তলায় পড়ে থাকব ! আর থাকতে পারলুম না—তখনই বাড়ি-ভিতরে মেজোরানীর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলুম। তিনি তখন বারান্দায় রোদরে বসে পান সাজছেন, পাশে থাকে৷ বসে। থাকোকে দেখে মুহুর্তের জন্তে মনটা সংকুচিত হল—তখনই সেটা কাটিয়ে নিয়ে মেজোরানীর পায়ের কাছে পড়ে তার পায়ের ধুলো নিলুম। তিনি বলে উঠলেন-ও কী লো ছোটোরানী তোর হল কী ? হঠাৎ এত ভক্তি কেন ? আমি বললুম, দিদি, আজ আমার জন্মতিথি। অনেক অপরাধ করেছি, করে। দিদি, আশীৰ্বাদ করে, আর যেন কোনোদিন তোমাদের কোনো দুঃখ না দিই। আমার ভারি ছোটো মন । বলেই তাকে আবার প্রণাম ক’রে তাড়াতাড়ি উঠে এলুম। তিনি পিছন থেকে বলতে লাগলেন, বলি ও ছুটু, তোর জন্মতিথি, এ-কথা আগে বলিস নি কেন ? আমার এখানে দুপুরবেলা তোর নেমস্তন্ন রইল। লক্ষ্মী বোন ভুলিস নে । ভগবান, এমন কিছু করো যাতে আজ আমার জন্মতিথি হয়। একেবারে নতুন হতে পারি নে কি ? সব ধুয়ে-মুছে আর-একবার গোড়া থেকে পরীক্ষা করে, প্রভু। বাইরে বৈঠকখানা-ঘরে যখন ঢুকতে যাচ্ছি এমন সময় সেখানে আজ সন্দীপ এসে উপস্থিত হল। বিতৃষ্ণায় সমস্ত মনটা যেন বিষিয়ে উঠল। আজ সকালের আলোয় তার যে-মুখ দেখলুম তাতে প্রতিভার জাদু একটুও ছিল না। আমি বলে উঠলুম,— আপনি যান এখান থেকে । সন্দীপ হেসে বললে, অমূল্য তো নেই, এবারে বিশেষ কথার পালা যে আমার। পোড়া কপাল ! যে-অধিকার আমিই দিয়েছি সে-অধিকার আজ ঠেকাই কী করে ? বললুম, আমার একলা থাকবার দরকার আছে। রানী, আর-একজন লোক ঘরে থাকলেও একলা থাকার ব্যাঘাত হয় না। আমাকে তুমি মনে ক’রো না ভিড়ের লোক,—আমি সন্দ্বীপ, লক্ষ লোকের মাঝেও আমি একলা ।