পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে He q জানতুম ফিরে ডাকবে। যে-চাদের টানে ভাট সেই চাদের টানেই জোয়ার। এমনি নিশ্চয় জানতুম তুমি ডাকবে যে, আমি দরজার কাছে অপেক্ষ করে বসেছিলুম। যেমনি তোমার বেহারাকে দেখেছি আমনি সে কিছু বলৰার পূর্বেই তাড়াতাড়ি বলে উঠলুম, আচ্ছা, আচ্ছা, আমি যাচ্ছি, এখনই যাচ্ছি।—ভোজপুরীটা আশ্চর্য হয়ে ই করে রইল। ভাবলে লোকটা মন্ত্রসিদ্ধ। মক্ষীরানী, সংসারে সব চেয়ে বড়ো লড়াই এই মন্ত্রের লড়াই । সন্মোহনে সম্মোহনে কাটাকাটি । এর বাণ শব্দভেদী বাণ— আবার নিঃশব্দভেদী বাণও আছে। এতদিন পরে এ লড়াইয়েই সন্দীপের সমকক্ষ মিলেছে। তোমার তুণে অনেক বাণ আছে, রণরঙ্গিণী। পৃথিবীর মধ্যে দেখলুম, কেবল তুমিই সন্দীপকে আপন ইচ্ছামতে ফেরাতে পারলে, আবার আপন ইচ্ছামতে টেনে আনলে। শিকার তো এসে পড়ল। এখন একে নিয়ে কী করবে বলে ? একেবারে নিঃশেষে মারবে, না, তোমার খাচায় পুরে রাখবে ? কিন্তু আগে থাকতে বলে রাখছি, রানী, এই জীবটিকে বধ করাও যেমন শক্ত, বন্ধ করাও তেমনি। অতএব দিব্য অস্ত্র তোমার হাতে যা আছে তার পরীক্ষা করতে বিলম্ব ক’রো না । সন্দীপের মনের ভিতরে একটা পরাভবের সংশয় এসেছে বলেই সে আজ এমন অনর্গল বকে গেল। আমার বিশ্বাস, ও জানত আমি অমূল্যকেই ডেকেছি—বেহার খুব সম্ভব তারই নাম বলেছিল ও তাকে ফাকি দিয়ে নিজে এসে উপস্থিত হয়েছে । আমাকে বলতে দেবার সময় দিলে না যে, ওকে ডাকি নি, অমূল্যকে ডেকেছি। কিন্তু আস্ফালন মিথ্যে—এবার দুর্বলকে দেখতে পেয়েছি। এখন আমার জয়লব্ধ জায়গাটির স্বচ্যগ্রভূমিও ছাড়তে পারব না । আমি বললুম, সন্দীপবাবু, আপনি গলগল করে এত কথা বলে যান কেমন করে ? আগে থাকতে বুঝি তৈরি হয়ে আসেন ? এক মুহূর্তে সন্দীপের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। আমি বললুম, শুনেছি কথকদের খাতায় নানারকমের লম্বালম্বা বর্ণনা লেখা থাকে, যখন যেটা যেখানে দরকার খাটিয়ে দেয় । আপনার সে-রকম খাতা আছে নাকি ? সন্দীপ চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল, বিধাতার প্রসাদে তোমাদের তো হাবভাবছলাকলার অস্ত নেই, তার উপরেও দরজির দোকান তাকরার দোকান তোমাদের সহায়, আর বিধাতা কি আমাদেরই এমনি নিরস্ত্র করে রেখেছেন যে— আমি বললুম, সন্দীপবাবু, খাতা দেখে আমুন—এ-কথাগুলো ঠিক হচ্ছে না। দেখছি এক-একবার আপনি উলটোপালটা বলে বসেন—খাত-মুখস্থর ওই একটা মস্ত দোষ।