পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে O)6. কাছে রেখে গেল, বললে, রানীমা এই বেনারসি কাপড় তোমারই বিয়েতে আমি পেয়েছিলুম। কাল যখন আমারই ঘরের লোহার সিন্দুক খোলা হবে তখন এই ক্ষেমা, থাকো, গয়লানী—থাৰু, সে-কথা কল্পনা করে হবে কী । বরঞ্চ ভাবি কালকের দিনের পর আর-এক বৎসর কেটে গেছে, আবার আর-একটা তেসরা মাঘের দিন এসেছে । সেদিনও কি আমার সংসারের সব কাটা ঘা এমনি কাটাই থেকে যাবে ? অমূল্য লিখেছে, সে আজ সন্ধ্যার মধ্যে ফিরবে। ইতিমধ্যে ঘরের মধ্যে এক বসে চুপ করে থাকতে পারি নে। আবার পিঠে তৈরি করতে গেলুম। যা তৈরি হয়েছে তা যথেষ্ট, কিন্তু আরও করতে হবে। এত কে খাবে ? বাড়ির সমস্ত দাসৗচাকরদের খাইয়ে দেব । আজ রাত্রেই খাওয়াতে হবে । আজ রাত পর্যস্ত আমার দিনের সীমা । কালকের দিন আর আমার হাতে নেই। পিঠের পরে পিঠে ভাজছি, বিশ্রাম নেই। এক-এক বার মনে হচ্ছে যেন উপরে আমার মহলের দিকে কী-একটা গোলমাল চলছে । হয়তো আমার স্বামী লোহার সিন্দুক খুলতে এসে চাবি খুজে পাচ্ছেন না । তাই নিয়ে মেজোরানী দাসীচাকরকে ডেকে একটা তোলপাড় কাও বাধিয়েছেন । না, আমি শুনব না, কিছু শুনব না, দরজা বন্ধ করে থাকব। দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছি এমন সময় দেখি থাকো তাড়াতাড়ি আসছে—সে র্হাপিয়ে বললে, ছোটোরানীমা । আমি বলে উঠলুম, যা যা, বিরক্ত করিস নে, আমার এখন সময় নেই –থাকো বললে, মেজোরানীমার বোনপো নন্দবাৰু কলকাতা থেকে এক কল এনেছেন সে মামুষের মতো গান করে, তাই মেজোরানীমা তোমাকে ডাকতে পাঠিয়েছেন। হাসব কি কাদব তাই ভাবি ! এর মাঝখানেও গ্রামোফোন ! তাতে যতবার দম দিচ্ছে সেই থিয়েটারের নাকিস্বর বেরোচ্ছে—ওর কোনো ভাবনা নেই। যন্ত্র যখন জীবনের নকল করে তখন তা এমনি বিষম বিদ্রুপ হয়েই ওঠে। সন্ধ্যা হয়ে গেল। জানি, অমূল্য এলেই আমাকে খবর পাঠাতে দেরি করবে না— তবু থাকতে পারলুম না, বেহারাকে ডেকে বললুম, অমূল্যবাবুকে খবর দাও। বেহার খানিকট ঘুরে এসে বললে, অমূল্যবাবু নেই। কথাটা কিছুই নয়, কিন্তু হঠাৎ আমার বুকের মধ্যে যেন তোলপাড় করে উঠল। অমূল্যবাবু নেই—সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে এ-কথাটা যেন কারার মতো বাজল ৷ নেই, সে নেই । সে সূর্যাস্তের সোনার রেখাটির মতো দেখা দিলে—তার পরে সে আর নেই! সম্ভব-অসম্ভৰ কত দুর্ঘটনার কল্পনাই আমার মাথার মধ্যে জমে উঠতে লাগল ।