পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে లిd আমি জিজ্ঞাসা করলুম, অমূল্য, এ কাজ কেন করতে গেলে ? সে বললে, আমার বিশেষ দরকার ছিল । তবে আবার ফিরিয়ে দিলে কেন ? ধার হকুমে ফিরিয়ে দিলুম তাকে ডাকুন, তার সামনে আমি বলব। তিনি কে ? ছোটোরানীদিদি । বিমলকে ডেকে পাঠালুম। সে একখানি সাদা শাল মাথার উপর দিয়ে ফিরিয়ে গা ঢেকে আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে ঢুকল—পায়ে জুতোও ছিল না। দেখে আমার মনে হল বিমলকে এমন যেন আর কখনো দেখি নি—সকালবেলাকার চাদের মতো ও যেন আপনাকে প্রভাতের আলো দিয়ে ঢেকে এনেছে। অমূল্য বিমলের পায়ের কাছে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে পায়ের ধুলো নিলে। উঠে দাড়িয়ে বললে, তোমার আদেশ পালন করে এসেছি দিদি । টাকা ফিরিয়ে দিয়েছি । বিমল বললে, বাচিয়েছ, ভাই । অমূল্য বললে, তোমাকে স্মরণ করেই একটি মিথ্যা কথাও বলি নি। আমার বন্দেমাতরং মন্ত্র রইল তোমার পায়ের তলায়। ফিরে এসে এই বাড়িতে ঢুকেই তোমার প্রসাদও পেয়েছি । বিমলা এ-কথাটা ঠিক বুঝতে পারলে না । অমূল্য পকেট থেকে রুমাল বের করে তার গ্রন্থি খুলে সঞ্চিত পিঠেগুলি দেখালে। বললে, সব খাই নি, কিছু রেখেছি— তুমি নিজের হাতে আমার পাতে তুলে দিয়ে খাওয়াবে বলে এইগুলি জমানো আছে । আমি বুঝলুম, এখানে আমার আর দরকার নেই ; ঘর থেকে বেরিয়ে গেলুম। মনে ভাবলুম, আমি তো কেবল বকে বকেই মরি, আর ওরা আমার কুশপুত্তলির গলায় ছেড়া জুতোর মালা পরিয়ে নদীর ধারে দাহ করে। কাউকে তো মরার পথ থেকে ফেরাতে পারি নে—যে পারে সে ইঙ্গিতেই পারে। আমাদের বাণীতে সেই অমোঘ ইঞ্জিত নেই। আমরা শিখা নই, আমরা অঙ্গার, আমরা নিবোনো, আমরা দীপ জালাতে পারব না। আমার জীবনের ইতিহাসে সেই কথাটাই প্রমাণ হল, আমার সাজানো বাতি জলল না ।