পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৬২ রবীন্দ্র-রচনাবলী বড়ো বড়ো সত্যকে সে আচ্ছন্ন করিয়া দাড়ায়, চন্দ্রস্তুর্থতারাকে সে মান করিয়া দেয় । ইহাতে আমাদের স্বষ্টি বিধাতার সঙ্গে বিরোধ করিতে থাকে। মনে করো নদী চলিতেছে ; তাহার প্রত্যেক ঢেউ স্বতন্ত্র হইয়া মাথা তুলিলেও তাহারা সকলে মিলিয়া সেই এক সমুদ্রের দিকে গান করিতে করিতে চলিতেছে। কেহ কাহাকেও বাধা দিতেছে না। কিন্তু ইহার মধ্যে যদি কোথাও পাক পড়িয়া যায়, তবে সেই ঘূর্ণ এক জায়গাতেই দাড়াইয়া উন্মত্তের মতো ঘুরিতে থাকে —চলিবার বাধা দিয়া ডুবাইবার চেষ্টা করে ; সমস্ত নদীর যে গতি, যে অভিপ্রায়, তাহাতে ব্যাঘাত জন্মাইয়া সে স্থিরত্বও লাভ করে না, অগ্রসর হইতেও পারে না । আমাদের কোনে-একটা প্রবৃত্তি উন্মত্ত হইয়া উঠিলে সেও আমাদিগকে নিখিলের প্রবাহ হইতে টানিয়া-লইয়া একটা বিন্দুর উপরেই ঘুরাইয়া মারিতে থাকে। আমাদের চিত্ত সেই একটা কেন্দ্রের চারিদিকেই বাধা পড়িয়া তাহার মধ্যেই আপনার সমস্ত বিসর্জন করিতে ও অন্তের সমস্ত নষ্ট করিতে চায়। এই উন্মত্ততার মধ্যে এক দল লোক একরকমের সৌন্দর্য দেখে। এমন কি, আমার মনে হয় যুরোপীয় সাহিত্যে এই পাক-খাওয়া প্রবৃত্তির ঘূর্ণিমৃত্যের প্রলয়োৎসব,-যাহার কোনো পরিণাম নাই, যাহার কোথাও শাস্তি নাই—তাহাতেই যেন বেশি মুখ পাইয়াছে। কিন্তু ইহাকে আমরা শিক্ষার সম্পূর্ণতা বলিতে পারি না, ইহা স্বভাবের বিকৃতি । সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে দেখিলে যাহাকে হঠাৎ মনোহর বলিয়া বোধ হয়, নিখিলের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিলেই তাহার সৌন্দর্যের বিরোধ চোখে ধরা পড়ে। মদের বৈঠকে মাতাল জগংসংসারকে ভুলিয়া গিয়া নিজেদের সভাকে বৈকুণ্ঠপুরী বলিয়া মনে করে, কিন্তু অপ্রমর দর্শক চারিদিকের সংসারের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিলেই তাহার বীভৎসত বুঝিতে পারে। আমাদের প্রবৃত্তিরও উৎপাত যখন ঘটে, তখন সে একটা অস্বাভাবিক দীপ্তিলাভ করিলেও বৃহৎ বিশ্বের মাঝখানে তাহাকে বরিয়া দেখিলেই তাহার কুহীতা বুঝিতে বিলম্ব হয় না। এমনি করিয়া স্থিরভাবে যে-ব্যক্তি বড়োর সঙ্গে ছোটোকে, সমগ্রের সঙ্গে প্রত্যেককে মিলাইয়া দেখিতে না জানে, সে উত্তেজনাকেই আনন্দ ও বিকৃতিকেই সৌন্দর্য বলিয়া ভ্রম করে। এইজন্যই সৌন্দর্যবোধকে পূর্ণভাবে লাভ করিতে হইলে চিত্তের শাস্তি চাই ; তাহ অসংযমের দ্বারা হইবার জো নাই। সৌন্দর্যবোধের সম্পূর্ণতা কোনদিকে চলিয়াছে, তাহাই দেখা যাক । ইহ দেখা গেছে, বর্বরজাতি যাহাকে স্বন্দর বলিয়া আদর করে, সভ্যজাতি তাহাকে দূরে ফেলিয়া দেয়। ইহার প্রধান কারণ, বর্বরের মন যেটুকু ক্ষেত্রের মধ্যে আছে,