পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য Ծ9Գ হালকা মেঘ বিনা করেণে গায়ে হাওয়া লাগাইয়া উড়িয়া বেড়ায়, তাহার উপরে যখন অস্তসূর্বের আলো পড়ে, তখন রঙের ছটায় চোখ ধাদিয়া যায়। কিন্তু আষাঢ়ের যে নূতন ঘনমেঘ পয়স্বিনী কালো গাভীটির মতো আসন্ন বৃষ্টির ভারে একেবার মন্থর হইয়া পড়িয়াছে, স্বাহার পুঞ্জ পুঞ্জ সজলতার মধ্যে বর্ণ বৈচিত্র্যের চাপল্য কোথাও নাই, সে আমাদের মনকে চারিদিক হইতে এমন করিয়া ঘনাইয়া ধরে যে, কোথাও যেন কিছু ফাক রাখে না। ধরণীর তাপশাস্তি, শস্তক্ষেত্রের দৈন্তনিবৃত্তি, নদীসরোবরের কৃশতামোচনের উদার আশ্বাস তাহার স্নিগ্ধ নীলিমার মধ্যে যে মাখানে ; মঙ্গলময় পরিপূর্ণতার গভীর মাধুর্ষে সে স্তন্ধ হইয়া থাকে। কালিদাস তো বসন্তের বাতাসকে বিরহী যক্ষের দৌত্যকার্ধে নিযুক্ত করিতে পারিতেন । এ-কার্ধে তাহার হাতযশ অাছে বলিয়া লোকে রটনা করে ; বিশেষত উত্তরে যাইতে হইলে দক্ষিনা-বাতাসকে কিছুমাত্র উজানে যাইতে হইত না । কিন্তু কবি প্রথম-আষাঢ়ের নূতন মেঘকেই পছন্দ করিলেন—সে যে জগতের তাপ নিবারণ করে—লে কি শুধু প্রণয়ীর বার্তা প্রণয়িনীর কানের কাছে প্রলপিত করিবে ? সে যে সমস্ত পথটার নদীগিরিকাননের উপর বিচিত্র পূর্ণতার সঞ্চার করিতে করিতে যাইবে। কদম্ব ফুটিবে, জম্বুকুঞ্জ ভরিয়া উঠিবে, বলাক উড়িয়া চলিবে, ভরা নদীর জল ছলছল করিয়া তাহার কুলের বেত্রবনে আসিয়া ঠেকিবে এবং জনপদবধূর ভবিলাসহীন প্রতিস্নিগ্ধলোচনের দৃষ্টিপাতে আষাঢ়ের আকাশ যেন আরও জুড়াইয়া যাইবে । বিরহীর বার্তাপ্রেরণকে সমস্ত পৃথিবীর মঙ্গলব্যাপারের সঙ্গে পদে-পদে গাথিয়া-গাথিয়া তবে কবির সৌন্দর্ধরসপিপাস্ব চিত্ত তৃপ্তিলাভ করিয়াছে। কুমারসম্ভবের কবি অকালবসন্তের আকস্মিক উৎসবে, পুষ্পশরের মোহবর্ষণের মধ্যে হরপার্বতীর মিলনকে চূড়াস্ত করিয়া তোলেন নাই। স্ত্রীপুরুষের উন্মত্ত সংঘাত হইতে ষে আগুন জলিয়া উঠিয়াছিল, সেই প্রলয়াগ্নিতে আগে তিনি শাস্তিধারা বর্ষণ করিয়াছেন, তবে তো মিলনের প্রতিষ্ঠা করিতে পারিলেন। কবি গৌরীর প্রেমের সর্বাপেক্ষা কমনীয় মূতি তপস্তার অগ্নির দ্বারাই উজ্জ্বল করিয়া দেখাইয়াছেন। সেখানে বসস্তের পুষ্পসম্পদ স্নান, কোকিলের মুখরতা স্তব্ধ। অভিজ্ঞান-শকুম্ভলেও প্রেয়সী যেখানে জননী হইয়াছেন, বাসনার চাঞ্চল্য যেখানে বেদনার তপস্তায় গাম্ভীর্যলাভ করিয়াছে, যেখানে অকুতাপের সঙ্গে ক্ষমা আসিয়া মিলিয়াছে, সেইখানেই রাজদম্পতির মিলন সর্থক হইয়াছে। প্রথম মিলনে প্ৰলয়, দ্বিতীয় মিলনেই পরিত্রাণ। এই দুই কাব্যেই শান্ডির মধ্যে মঙ্গলের মধ্যে যেখানেই কবি সৌন্দর্ধের সম্পূর্ণতা দেখাইয়াছেন, সেখানেই তাহার তুলিক বর্ণৰিৱল, তাহার বীণা অপ্ৰমত্ত।