পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 o'S রবীন্দ্র-রচনাবলী পল্লীসাহিত্যকে বৃহৎ সাহিত্যে বাধিবার প্রয়াস। এমনি করিয়া একটা বড়ো জায়গায় আপনার প্রাণপদার্থকে মিলাইয়া দিয়া পল্লীসাহিত্য, ফল-ধরা হইলেই ফুলের পাপড়িওলার মতো ঝরিয়া পড়িয়া যায়। পঞ্চতন্ত্র, কথাসরিৎসাগর, আরব্য উপভাস, ইংলণ্ডের আর্থারকাহিনী, স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ার সাগ-সাহিত্য এমনি করিয়া জন্মিয়াছে—সেইগুলির মধ্যে লোকমুখের বিক্ষিপ্ত কথা এক জায়গায় বড়ো আকারে দানা বাধিবার চেষ্টা করিয়াছে । এইরূপ ছড়ানো ভাবের এক হইয়া উঠিবার চেষ্টা মানবসাহিত্যে কয়েক জায়গায় অতি আশ্চর্য বিকাশ লাভ করিয়াছে । গ্রীসে হোমরের কাব্য এবং ভারতবর্ষে রামায়ণ-মহাভারত । ইলিয়াড এবং অডেসিতে নানা খণ্ডগাথা ক্রমে ক্রমে স্তরে স্তরে জোড়া লাগিয়া এক হইয়া উঠিয়াছে, এ-মত প্রায় মোটামুটি সর্বত্রই চলিত হইয়াছে। ষে-সময়ে লেখা-পুথি এবং ছাপ-বইয়ের চলন ছিল না, এবং যখন গায়কেরা কাব্য গান করিয়া শুনাইয়া বেড়াইত, তখন যে ক্রমে নানা কালে ও নানা হাতে একটা কাব্য ভরাট হইয়া উঠিতে থাকিবে, তাহাতে আশ্চর্ষের কথা নাই। কিন্তু যে-কাঠামোর মধ্যে এই কাব্যগুলি খাড়া হইবার জায়গা পাইয়াছে, তাহা যে একজন বড়ো কবির রচনা, তাহাতে সন্দেহ নাই। কারণ, এই কাঠামোর গঠন অনুসরণ করিয়া নূতন নূতন জোড়াগুলি ঐক্যের গণ্ডি হইতে ভ্ৰষ্ট হইতে পায় নাই। মিথিলার বিদ্যাপতির গান কেমন করিয়া বাংলা পদাবলী হইয়া উঠিয়াছে তাহা দেখিলেই বুঝা যাইবে, স্বভাবের নিয়মে এক কেমন করিয়া আর হইয়া উঠিতেছে । বাংলায় প্রচলিত বিদ্যাপতির পদাবলীকে বিদ্যাপতির বলা চলে না। মূল কবির প্রায় কিছুই তাহার অধিকাংশ পদেই নাই । ক্রমেই বাঙালি গায়ক ও বাঙালি শ্রোতার যোগে তাহার ভাষা, তাহার অর্থ, এমন কি তাহার রসেরও পরিবর্তন হইয়া সে এক নূতন জিনিস হইয়া দাড়াইয়াছে। গ্রিয়সন মূল বিদ্যাপতির যে-সকল পদ প্রকাশ করিয়াছেন, ৰাংলা পদাবলীতে তাহার দুটি-চারটির ঠিকানা মেলে, বেশির ভাগই মিলাইতে পারা যায় না । অথচ নানা কাল ও নানা লোকের দ্বারা পরিবর্তনসত্ত্বেও পদগুলি এলোমেলো প্রলাপের মতো হইয়া যায় নাই । কারণ, একটা মূলম্বর মাঝখানে থাকিয়া সমস্ত পরিবর্তনকে আপনার করিয়া লইবার জন্য সর্বদা সতর্ক হইয়া বসিয়া আছে। সেই স্বরটুকুর জোরেই এই পদগুলিকে বিদ্যাপতির পদ বলিতেছি, আবার আগাগোড়া পরিবর্তনের জোরে এগুলিকে বাঙালির সাহিত্য বলিতে কুষ্ঠিত হইবার কারণ নাই।