পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

888 রবীন্দ্র-রচনাবলী মুহূর্তে দূর হইল, অলংকারশাস্ত্রের পাষাণবন্ধনসকল কেমন করিয়া এক মুহূর্তে বিদীর্ণ হইল, ভাষা এত শক্তি পাইল কোথায়, ছন্দ এত সংগীত কোথা হইতে আহরণ করিল ? বিদেশী সাহিত্যের অন্থকরণে নহে, প্রবীণ সমালোচকের অনুশাসনে নহে— দেশ আপনার বীণায় আপনি স্বর বাধিয়া আপনার গান ধরিল। প্রকাশ করিবার আনন্দ এত, আবেগ এত যে, তখনকার উন্নত মার্জিত কালোয়াতি সংগীত থই পাইল না, দেখিতে দেখিতে দশে মিলিয়া এক অপূর্ব সংগীতপ্রণালী তৈরি করিল, আরকোনো সংগীতের সহিত তাহার সম্পূর্ণ সাদৃশ্ব পাওয়া শক্ত। মুক্তি কেবল জ্ঞানীর নহে, ভগবান কেবল শাস্ত্রের নহেন, এই মন্ত্র যেমনি উচ্চারিত হইল, অমনি দেশের যত পাখি সুপ্ত হইয়া ছিল, সকলেই এক নিমেষে জাগরিত হইয়া গান ধরিল। ইহা হইতেই দেখা যাইতেছে, বাংলাদেশ আপনাকে যথার্থভাবে অনুভব করিয়াছিল বৈষ্ণবযুগে। সেই সময়ে এমন একটি গৌরব সে প্রাপ্ত হইয়াছিল, যাহা অলোকসামান্ত, যাহা বিশেষরূপে বাংলাদেশের—যাহা এ-দেশ হইতে উচ্ছ্বসিত হইয়া অন্তত্র বিস্তারিত হইয়াছিল। শাক্তযুগে তাহার দীনতা ঘোচে নাই, বরঞ্চ নানারূপে পরিস্ফুট হইয়াছিল, বৈষ্ণবযুগে অযাচিত-ঐশ্বৰ্ষলাভে সে আশ্চর্যরূপে চরিতার্থ হইয়াছে । শাক্ত যে-পূজা অবলম্বন করিয়াছিল, তাহা তখনকার কালের অনুগামী। অর্থাৎ সমাজে তখন যে-অবস্থা ঘটিয়াছিল, যে-শক্তির খেলা প্রত্যহ প্রত্যক্ষ হইতেছিল, যে-সকল আকস্মিক উত্থানপতন লোককে প্রবলবেগে চকিত করিয়া দিতেছিল—মনে মনে তাহাকেই দেবত্ব দিয়া, শাক্তধর্ম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল। বৈষ্ণবধর্ম এক ভাবের উচ্ছ্বাসে সাময়িক অবস্থাকে লঙ্ঘন করিয়া তাহাকে প্লাবিত করিয়া দিয়াছিল। সাময়িক অবস্থার বন্ধন হইতে এক বৃহৎ আনন্দের মধ্যে সকলকে নিষ্কৃতিদান কুরিয়াছিল। শক্তি যখন সকলকে পেষণ করিতেছিল, উচ্চ যখন নীচকে দলন করিতেছিল, তখনই সে প্রেমের কথা বলিয়াছিল। তখনই সে ভগবানকে তাহার রাজসিংহাসন হইতে আপনাদের খেলাঘরে নিমন্ত্ৰণ করিয়া আনিয়াছিল—এমন কি, প্রেমের স্পর্ধায় সে ভগবানের ঐশ্বর্যকে উপহাস করিয়াছিল। ইহাতে করিয়া, যে-ব্যক্তি তৃণাদপি নীচ, সে-ও গৌরব লাভ করিল ; যে ভিক্ষার ঝুলি লইয়াছে, সে-ও সন্মান পাইল ; ষে ম্লেচ্ছাচারী, সে-ও পবিত্র হইল। তখন সাধারণের হৃদয় রাজার পীড়ন সমাজের শাসনের উপরে উঠিয়া গেল। বাহ অবস্থা সমানই রহিল, কিন্তু মন সেই অবস্থার দাসত্ব হইতে মুক্ত হইয়া নিখিলজগৎসভার মধ্যে স্থানলাভ করিল। প্রেমের অধিকারে সৌন্দর্যের অধিকারে ভগবানের অধিকারে কাহারও কোনো বাধা রহিল না।