পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ዓõ রবীন্দ্র-রচনাবলী কখনো মনের মধ্যে একটা বৃহৎ বৈরাগ্যের আভাস আনে, কখনো বা অমুরাগের প্রগাঢ় আনন্দ উদ্রেক করে। সন্ধ্যার বর্ণনায় কেবল সে সুর্যাস্তের আভা পড়ে তা নয়, তার সঙ্গে লেখকের মানবহৃদয়ের আভা কখনো মান শ্রাস্তির ভাবে, কখনো গভীর শাস্তির ভাবে, স্পষ্টত অথবা অস্পষ্টত মিশ্রিত থাকে এবং সেই আমাদের হৃদয়কে অনুরূপ ভাবে রঞ্জিত করে তোলে। নতুবা, তুমি যে-রকম বর্ণনার কথা বলেছ সে-রকম বর্ণনা ভাষায় অসম্ভব । ভাষা কখনোই রেখাবর্ণময় চিত্রের মতো অমিশ্র অবিকল প্রতিরূপ আমাদের সম্মুখে আনয়ন করতে পারে না। বলা বাহুল্য, যেমন-তেমন লেখকের যেমন-তেমন বিশেষত্বই যে আমরা প্রার্থনীয় জ্ঞান করি তা নয়। মনে করো, পথ দিয়ে মস্ত একটা উৎসবের যাত্রা চলেছে। আমার এক বন্ধুর বারান্দা থেকে তার একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ দেখতে পাই, আর এক বন্ধুর বারানা থেকে বৃহৎ অংশ এবং প্রধান অংশ দেখতে পাই—আর এক বন্ধু আছেন তার দোতলায় উঠে যেদিক থেকেই দেখতে চেষ্টা করি কেবল তার নিজের বারান্দার্টুকুই দেখি । প্রত্যেক লোক আপন আপন বিশেষত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে জগতের এক-একটা দৃপ্ত দেখছে—কেউ বা বৃহৎ ভাবে দেখছে, কেউ বা কেবল আপনাকেই দেখছে। যে আপনাকে ছাড়া আর কিছুই দেখাতে পারে না সাহিত্যের পক্ষে সে বাতায়নহীন অন্ধকার কারাগার মাত্র । কিন্তু এ উপমায় আমার কথাটা পুরো বলা হল না, এবং ঠিকটি বলা হল না। আমার প্রধান কথাটা এই—সাহিত্যের জগং মানেই হচ্ছে মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশ্রিত জগৎ । স্বর্যাস্তকে তিন রকম ভাবে দেখা যাক । বিজ্ঞানের স্বর্যাস্ত, চিত্রের সুর্বাস্ত এবং সাহিত্যের স্বর্যাস্ত । বিজ্ঞানের স্বর্যাস্ত হচ্ছে, নিছক স্বর্যাস্ত ঘটনাটি ; চিত্রের সূর্যাস্ত হচ্ছে, কেবল স্বর্ষের অন্তৰ্ধনিমাত্র নয়, জল-স্থল-আকাশ-মেঘের সঙ্গে মিশ্রিত করে স্বর্যাস্ত দেখা ; সাহিত্যের স্বর্যাস্ত হচ্ছে, সেই জল-স্থল-আকাশ-মেঘের মধ্যবর্তী সূর্যাস্তকে মানুষের জীবনের উপর প্রতিফলিত করে দেখা ; কেবলমাত্র সূর্বাস্তের ফোটোগ্রাফ তোলা নয়, আমাদের মর্মের সঙ্গে তাকে মিশ্রিত করে প্রকাশ । যেমন, সমুদ্রের জলের উপর সন্ধ্যাকাশের প্রতিবিম্ব পড়ে একটা অপরূপ সৌন্দর্ষের উদ্ভব হয়, আকাশের উজ্জল ছায়া জলের স্বচ্ছ তরলতার ৰোগে একটা নূতন ধর্ম প্রাপ্ত হয় ; তেমনি জগতের প্রতিবিম্ব মানবের জীবনের মধ্যে পতিত হয়ে সেখান থেকে প্রাণ ও হৃদয়বৃত্তি লাভ করে। আমরা প্রকৃতিকে আমাদের নিজের স্থখছুঃখ-আশাআকাক্ষা দান করে একটা নূতন কাও করে তুলি ; অস্ত্ৰভেদী জগৎসৌন্দর্ষের মধ্যে একটা অমর প্রাণপ্রতিষ্ঠা করি ; এবং তখনই সে সাহিত্যের উপযোগিতা প্রাপ্ত হয় ।