পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G o o রবীন্দ্র-রচনাবলী বৈষ্ণবকাব্যই আমাদের দেশের সাহিত্যকে প্রথম রাজসভার সংকীর্ণ আশ্রয় হইতে বৃহৎভাবে জনসমাজের মধ্যে বাহির করিয়া আনিল। পর্বতের গুহ ভেদ করিয়া ঝরনা বাহির হইল। কিন্তু নানা দিক হইতে নানা ধারা আসিয়া না জুটিলে নদী হয় না। আজ বাংলায় গদ্যে-পদ্যে সম্মিলিত সাহিত্য বাঙালি-জনসাধারণের হৃদয় হইতে বিচিত্র ভাবস্রোত বিবিধ জ্ঞানপ্রবাহ অহরহ আকর্ষণ করিয়া পরিপুষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। এই সাহিত্যেই বাংলার উত্তরদক্ষিণ-পূর্বপশ্চিম সমস্ত প্রদেশ নিরস্তর আপনাকে মিলিত করিতেছে। নিখিল বাঙালির এই হৃদয়সংগমস্থলই বাঙালির সর্বপ্রধান মিলনতীর্থ। এই তীর্থেই আমাদের জাগ্রত-দেবতার নিত্য অধিষ্ঠান হইবে এবং এইখানেই আমরা আমাদের সমস্ত যত্ন প্রীতি ও নৈপুণ্যের দ্বারা এমন ধর্মশালা নির্মাণ করিব, যেখানে চিরদিন আমাদের উত্তরকালীন যাত্ৰিগণ আশ্রয় লাভ করিতে পারিবে । সাহিত্যের নামে আমরা আজ এই যে মিলনের সভা আহবান করিয়াছি, এই মিলনের বিশেষ সার্থকতা প্রমাণ করিবার জন্য সাহিত্যের মূলতত্বের প্রতি আপনাদের মনোযোগ প্রবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিলাম। রাজনৈতিক মিলনের মধ্যে বিরোধের বীজ আছে, তাহাতে পরজাতির সহিত সংঘাত আছে, কিন্তু আমাদের সাহিত্যের মিলন বিশুদ্ধ মিলন—তাহাতে পরের প্রতি বিরোধ দৃষ্টি দিবার কোনো প্রয়োজন নাই, তাহা একান্তভাবে স্বজাতির কল্যাণকর । বঙ্গসাহিত্যে বাঙালি নিজের যে-পরিচয় পাইয়াছে, তাহা তাহার আত্মশক্তি হইতেই উদ্ভূত, এই কারণে সাহিত্যসম্মিলনে আমরা ক্ষুন্ন অভিমানের দৰ্পে অন্যের প্রতি তর্জনগর্জন করিয়া তৃপ্তিলাভের চেষ্টা করিব না। দুর্ভাগ্যক্রমে বর্তমানে আমাদের এমন সময় আসিয়াছে, যখন নানা পীড়নে নানা তাড়নায় আমরা পরসংঘাতের বেদনা এক মুহূর্তের জন্তও ভুলিতে পারিতেছি না— এরূপ অবস্থা ব্যাধির অবস্থা। এমন অবস্থায় আমাদের প্রকৃতি তাহার স্বাভাবিক ক্রিয়া সম্পন্ন করিতে পারে না । কিন্তু পরজাত বেদনা ক্ষণকালের জন্য ভুলিয়া নিজের মধ্যে আমরা যদি শাস্তি ও প্রতিষ্ঠা অনুভব করিতে চাই, যদি নানা দুর্বোগের মধ্যেও আশার ধ্রুবতারাকে উজ্জলন্ধপে দেখিয়া আমরা বরলাভ করিতে ইচ্ছা করি, তবে এই সাহিত্যের সন্মিলনই তাহার উপায়। যেখানে বেদনা, সেইখানেই স্বভাবত বারংবার হাত পড়ে বটে, কিন্তু ব্যথাকে বারংবার স্পর্শদ্বারা ব্যথিততর করিয়া তোলাই আরোগ্যের উপায় নহে। সেই বিশেষ বেদনাকে ভুলিয়া সমস্ত দেহের আভ্যন্তরিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন প্রয়োগ করিলে যথাসময়ে এই বেদনা ক্ষীণ হইয়া আসে। আমাদিগকেও এইরূপ চিকিৎসা অবলম্বন করিতে হইবে—দিনরাত্রি কেবল অমুখের প্রতিই সমস্ত লক্ষ্য নিবন্ধ রাখিলে আমাদের কল্যাণ হইবে না। যেখানে