পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vr রবীন্দ্র-রচনাবলী অধ্যাপকের প্রবেশ অধ্যাপক । নন্দিনী ! যেয়ো না, ফিরে চাও । নন্দিনী । কী অধ্যাপক । অধ্যাপক । ক্ষণে ক্ষণে আমন চমক লাগিয়ে দিয়ে চলে যাও কেন । যখন মনটাকে নাড়া দিয়েই যাও তখন নাহয় সাড়া দিয়েই বা গেলে । একটু দাড়াও, দুটাে কথা বলি । নন্দিনী । আমাকে তোমার কিসের দরকার । অধ্যাপক। দরকারের কথা যদি বললে, ঐ চেয়ে দেখো । আমাদের খোদাইকরের দল পৃথিবীর বুক চিরে দরকারের-বোঝা-মাথায় কীটের মতো সুড়ঙ্গর ভিতর থেকে উপরে উঠে আসছে। এই যক্ষপুরে আমাদের যা-কিছু ধন সব ঐ ধুলোর নাড়ির ধন- সোনা । কিন্তু সুন্দরী, তুমি যে-সোনা সে তো ধুলোর নয়, সে যে আলোর । দরকারের বাধনে তাকে কে বাঁধবে। নন্দিনী । বারে বারে ঐ একই কথা বল । আমাকে দেখে তোমার এত বিস্ময় কিসের অধ্যাপক । অধ্যাপক। সকালে ফুলের বনে যে আলো আসে তাতে বিস্ময় নেই, কিন্তু পাকা দেয়ালের ফাটল দিয়ে যে আলো আসে সে আর-এক কথা । যক্ষপুরে তুমি সেই আচমকা আলো । তুমিই বা এখানকার কথা কী ভাবিছ বলে দেখি । নন্দিনী । অবাক হয়ে দেখছি, সমস্ত শহর মাটির তলাটার মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে অন্ধকার হাতড়ে বেড়াচ্ছে। পাতালে সুড়ঙ্গ খুদে তোমরা যাক্ষের ধন বের করে করে আনছ । সে যে অনেক যুগের মরা ধন, পৃথিবী তাকে কবর দিয়ে রেখেছিল। অধ্যাপক । আমরা-যে সেই মরা ধনের শব্বসাধনা করি । তার প্রেতকে বশ করতে চাই । সোনার তালের তালবেতালকে বাধতে পারলে পৃথিবীকে পাব মুঠোর মধ্যে । নন্দিনী । তার পরে আবার, তোমাদের রাজাকে এই একটা অদ্ভুত জালের দেয়ালের আড়ালে ঢাকা দিয়ে রেখেছ, সে-যে মানুষ পাছে সে কথা ধরা পড়ে । তোমাদের ঐ সুড়ঙ্গের অন্ধকার ডালটা খুলে ফেলে তার মধ্যে আলো ঢেলে দিতে ইচ্ছে করে, তেমনি ইচ্ছে করে ঐ বিশ্ৰী জালটাকে ছিড়ে ফেলে মানুষটাকে উদ্ধার করি । অধ্যাপক । আমাদের মরা ধনের প্রেতের যেমন ভয়ংকর শক্তি, আমাদের মানুষ-স্থাকা রাজারও তেমনি ভয়ংকর প্রতাপ । নন্দিনী । এ-সব তোমাদের বানিয়ে-তোলা কথা । , অধ্যাপক । বানিয়ে- তোলাই তো । উলঙ্গের কোনো পরিচয় নেই, বানিয়ে তোলা কাপড়েই কেউ-বা রাজা, কেউ-বা ভিখিরি 1 এসো আমার ঘরে । তোমাকে তত্ত্বকথা বুঝিয়ে দিতে বড়ো আনন্দ হয় । নন্দিনী । তোমাদের খোদাইকর যেমন খনি খুদে খুদে মাটির মধ্যে তলিয়ে চলেছে, তুমিও তো তেমনি দিনরাত পুঁথির মধ্যে গর্ত খুঁড়েই চলেছ । আমাকে নিয়ে সময়ের বাজে খরচ করবে। কেন । অধ্যাপক । আমরা নিরেট নিরবকাশ-গর্তের পতঙ্গ, ঘন কাজের মধ্যে সেঁধিয়ে আছি ; তুমি ফাকা সময়ের আকাশে সন্ধ্যাতারাটি, তোমাকে দেখে আমাদের ডানা চঞ্চল হয়ে ওঠে । এসো আমার ঘরে, তোমাকে নিয়ে একটু সময় নষ্ট করতে দাও । নন্দিনী । না না, এখন না । আমি এসেছি তোমাদের রাজাকে তার ঘরের মধ্যে গিয়ে দেখব ! অধ্যাপক ! সে থাকে জালের আড়ালে, ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেবে না। ’ নন্দিনী । আমি জালের বাধা মানি নে, আমি এসেছি। ঘরের মধ্যে ঢুকতে । অধ্যাপক । জান নন্দিনী, আমিও আছি। একটা জালের পিছনে ? মানুষের অনেকখানি বাদ দিয়ে পণ্ডিতটুকু জেগে আছে । আমাদের রাজা যেমন ভয়ংকর, আমিও তেমনি ভয়ংকর পণ্ডিত । নন্দিনী । আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছি তুমি । তোমাকে তো ভয়ংকর ঠেকে না। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, এরা আমাকে এখানে নিয়ে এল, রঞ্জনকে সঙ্গে আনলে না কেন ।