পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

引国匀区 @ oԳ নবদ্বীপের পক্ষে সাক্ষ্য দিল । জয়শ্ৰী যখন বরদাসুন্দরীকে ত্যাগ করিয়া অন্য পক্ষে যাইবার আয়োজন করিতেছে, তখন রামকানাইকে ডাক পড়িল । অনাহারে মৃতপ্ৰায় শুষ্কওষ্ঠ শুষ্করসনা বৃদ্ধ কম্পিত শীর্ণ অঙ্গুলি দিয়া সাক্ষ্যমঞ্চের কাঠগড়া চাপিয়া ধরিলেন । চতুর ব্যারিস্টার অত্যন্ত কৌশলে কথা বাহির করিয়া লইবার জন্য জেরা করিতে আরম্ভ করিলেন- বহুদূর হইতে আরম্ভ করিয়া সাবধানে অতি ধীর বক্রগতিতে প্রসঙ্গের নিকটবতী হইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন । তখন রামকানাই জজের দিকে ফিরিয়া জোড়হন্তে কহিলেন, “হুজুর, আমি বৃদ্ধি, অত্যন্ত দুর্বল। অধিক কথা কহিবার সামর্থ্য নাই । আমার যা বলিবার সংক্ষেপে বলিয়া লই । আমার দাদা স্বগীয় গুরুচরণ চক্রবর্তী মৃত্যুকালে সমস্ত বিষয়সম্পত্তি র্তাহার পত্নী শ্ৰীমতী বরদাসুন্দরীকে উইল করিয়া দিয়া যান। সে উইল আমি নিজহস্তে লিখিয়াছি এবং দাদা নিজহস্তে স্বাক্ষর করিয়াছেন । আমার পুত্র নবদ্বীপচন্দ্ৰ যে উইল দাখিল করিয়াছেন তাহা মিথ্যা।” এই বলিয়া রামকানাই কঁাপিতে কঁাপিতে মূৰ্ছিত হইয়া পড়িলেন । চতুর ব্যারিস্টার সকৌতুকে পার্শ্ববতী অ্যাটর্নিকে বলিলেন, “বাই জোভ! লোকটাকে কেমন ঠেসে ধরেছিলুম।” মামাতো ভাই ছুটিয়া গিয়া দিদিকে বলিল, “বুড়ো সমস্ত মাটি করিয়াছিল- আমার সাক্ষ্যে মকদ্দমা রক্ষা পায় ।” দিদি বলিলেন, “বটে ! লোক কে চিনতে পারে । আমি বুড়োকে ভালো বলে জানতুম।” কারাবারুদ্ধ নবদ্বীপের বুদ্ধিমান বন্ধুরা অনেক ভাবিয়া স্থির করিল, নিশ্চয়ই বৃদ্ধ ভয়ে এই কাজ করিয়া ফেলিয়াছে ; সাক্ষীর বাক্সের মধ্যে উঠিয়া বুড়া বুদ্ধি ঠিক রাখিতে পারে নাই ; এমনতরো আস্ত নির্বোধি সমস্ত শহর খুজিলে মিলে না। গৃহে ফিরিয়া আসিয়া রামকানাইয়ের কঠিন বিকার-জ্বর উপস্থিত হইল। প্ৰলাপে পুত্রের নাম উচ্চারণ করিতে করিতে এই নির্বোিধ সৰ্বকৰ্মপণ্ডকারী নবদ্বীপের অনাবশ্যক বাপ পৃথিবী হইতে অপসৃত হইয়া গেল ; মুকুন্তু কেহ কেহ কহল, "আর কিছুদিন পূর্বে গেলেই ভালো ইত— কিন্তু তাহদের নাম R | Sobr ? ব্যবধান সম্পর্ক মিলাইয়া দেখিতে গেলে বনমালী এবং হিমাংশুমালী উভয়ে মামাতো পিসতুতো ভাই ; সেও অনেক হিসাব করিয়া দেখিলে তবে মেলে। কিন্তু ইহাদের দুই পরিবার বহুকাল হইতে প্রতিবেশী, মাঝে কেবল একটা বাগানের ব্যবধান, এইজন্য ইহাদের সম্পর্ক নিতান্ত নিকট না হইলেও ঘনিষ্ঠতার অভাব নাই । বনমালী হিমাংশুর চেয়ে অনেক বড়ো । হিমাংশুর যখন দন্ত এবং বাক্যস্ফুর্তি হয় নাই, তখন বনমালী তাহাকে কোলে করিয়া এই বাগানে সকালে সন্ধ্যায় হাওয়া খাওয়াইয়াছে, খেলা করিয়াছে, কান্না থামাইয়াছে, ঘুম পাড়াইয়াছে এবং শিশুর মনোরঞ্জন করিবার জন্য পরিণতবুদ্ধি বয়স্ক লোকদিগকে সবেগে শিরশ্চিালন, তারস্বরে প্রলাপভাষণ প্রভৃতি যে-সকল বয়সানুচিত চাপল্য এবং উৎকট উদ্যম প্রকাশ করিতে হয়, বনমালী তাহাও করিতে ক্ৰটি করে নাই । বনমালী লেখাপড়া বড়ো-একটা কিছু করে নাই । তাহার বাগানের শখ ছিল এবং এই ছোটােভাইটি ছিল । ইহাকে খুব একটি দুর্লভ দুর্মুল্য লতার মতো বনমালী হৃদয়ের সমস্ত স্নেহসিঞ্চন করিয়া পালন করিতেছিল এবং সে যখন তাহার সমস্ত অন্তরবাহিরকে আচ্ছন্ন করিয়া লতাইয়া উঠিতে লাগিল, তখন বনমালী আপনাকে ধন্য জ্ঞান করিল।