পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

5-Met (*RGł লাগাস নাই। আমার নতুন জালে আঠা দেওয়া হয় নাই, আমার নীেকো-" “তোর আবার দিদি কে রে তিন্নি ।” : জুলিখা কোথা হইতে বাহির হইয়া আসিয়া কহিল, “আমি।” বৃদ্ধ অবাক হইয়া গেল। তার পর জুলিখার অনেক কাছে আসিয়া ভালো করিয়া তাহার মুখ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল । খাপ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুই কাজ-কাম কিছু জানিস ?” আমিনা কহিল, “বুঢ়া, দিদির হইয়া আমি কাজ করিয়া দিব । দিদি কাজ করিতে পরিবে না ।” বৃদ্ধ কিয়ৎক্ষণ ভাবিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুই থাকিবি কোথায় ।” জুলিখা বলিল, “আমিনার কাছে।” বৃদ্ধ ভাবিল, এও তো বিষম বিপদ । জিজ্ঞাসা করিল, “খাইবি কী ।” জুলিখা বলিল “তাহার উপায় আছে - বলিয়া অবজ্ঞাভরে ধীবরের সম্মুখে একটা স্বর্ণমুদ্রা ফেলিয়া निोव्न | আমিনা সেটা কুড়াইয়া ধীবরের হাতে তুলিয়া দিয়া চুপিচুপি কহিল, “বুঢ়া, আর-কোনো কথা কহিস না । তুই কাজে যা, বেলা হইয়াছে।” জুলিখা ছদ্মবেশে নানা স্থানে ভ্ৰমণ করিয়া অবশেষে আমিনার সন্ধান পাইয়া কী করিয়া ধীবরের কুটিরে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে সে-সমস্ত কথা বলিতে গেলে দ্বিতীয় আর-একটি কাহিনী হইয়া পড়ে । তাহার রক্ষাকর্তা রহমত শেখ ছদ্মনামে আরাকান রাজসভায় কাজ করিতেছে । দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ছোটাে নদীটি বহিয়া যাইতেছিল এবং প্রথম গ্ৰীষ্মের শীতল প্রভাতবায়ুতে কৈলু গাছের রক্তবর্ণ পুষ্পমঞ্জরী হইতে ফুল ঝরিয়া পড়িতেছিল। গাছের তলায় বসিয়া জুলিখা আমিনাকে কহিল, ঈশ্বর যে আমাদের দুই ভগ্নীকে মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করিয়াছেন সে কেবল পিতার হত্যার প্রতিশোধ লইবার জন্য । নহিলে আর তো কোনো কারণ খুঁজিয়া পাই • * কহিল, “দিদি, আর ও-সব কথা বলিস নে ভাই । আমার এই পৃথিবীটা একরকম বেশ লাগিতেছে । মরিতে চায় তো পুরুষগুলো কাটাকাটি করিয়া মরুক গে, আমার এখানে কোনো দুঃখ নাই ।” জুলিখা বলিল, “ছি ছি আমিনা, তুই কি শাহজাদার ঘরের মেয়ে । কোথায় দিল্লির সিংহাসন আর কোথায় আরাকানের ধীবরের কুটির ” আমিনা হাসিয়া কহিল, “দিদি, দিল্লির সিংহাসনের চেয়ে আমার বুঢ়ার এই কুটির এবং এই কৈলু গাছের ছায়া যদি কোনো বালিকার বেশি ভালো লাগে তাহাতে দিল্লির সিংহাসন এক বিন্দু অশ্রুপাত করিবে না ।” জুলিখা কতকটা আনমনে কতকটা আমিনাকে কহিল, “তা, তোকে দোষ দেওয়া যায় না, তুই তখন নিতান্ত ছোটো ছিল— কিন্তু একবার ভাবিয়া দেখ, পিতা তোকে সব চেয়ে বেশি ভালোবাসিতেন বলিয়া তোকেই স্বহস্তে জলে ফেলিয়া দিয়াছিলেন । সেই পিতৃদত্ত মৃত্যুর চেয়ে এই জীবনকে বেশি প্ৰিয় জ্ঞান করিস না। তবে যদি প্ৰতিশোধ তুলিতে পারিস। তবেই জীবনের অর্থ থাকে৷ ” আমিনা চুপ করিয়া দূরে চাহিয়া রহিল। কিন্তু বেশ বুঝা গেল, সকল কথা সত্ত্বেও বাহিরের এই বাতাস এবং গাছের ছায়া এবং আপনার নবযৌবন এবং কী-একটা সুখস্মৃতি তাহাকে নিমগ্ন করিয়া রাখিয়াছিল । কিছুক্ষণ পরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, "দিদি, তুমি একটু অপেক্ষা করো ভাই। আমার ঘরের কাজ বাকি আছে। আমি না। রাধিয়া দিলে বুঢ়া খাইতে পাইবে না।”