পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO SR রবীন্দ্র-রচনাবলী নাই। আর তোমার সেই ভুবনমোহন পূর্ণযৌবনের রূপ রজনীর অন্ধকারপটের উপরে জাজ্বল্যমান হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। আর অধিক বলিতে হইবে না।” “আমার কেহ সঙ্গিনী ছিল না। দাদা প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, বিবাহ করিবেন না। অন্তঃপুরে আমি একা । বাগানের গাছতলায় আমি একা বসিয়া ভাবিতাম, সমস্ত পৃথিবী আমাকেই ভালোবাসিতেছে, সমস্ত তারা আমাকে নিরীক্ষণ করিতেছে, বাতাস ছল করিয়া বার বার দীর্ঘনিশ্বাসে পাশ দিয়া চলিয়া যাইতেছে এবং যে তৃণাসনে পা দুটি মেলিয়া বসিয়া আছি তাহার যদি চেতনা থাকিত তবে সে পুনর্বর অচেতন হইয়া যাইত । পৃথিবীর সমস্ত যুবাপুরুষ ঐ তৃণপুঞ্জরূপে দল বাধিয়া নিস্তব্ধে আমার চরণবতী হইয়া দাড়াইয়াছে এইরূপ আমি কল্পনা করিতাম ; হৃদয়ে অকারণে কেমন বেদনা অনুভব হইত। ‘দাদার বন্ধু শশিশেখর যখন মেডিকাল কলেজ হইতে পাস হইয়া আসিলেন তখন তিনিই আমাদের বাড়ির ডাক্তার হইলেন। আমি তাহাকে পূর্বে আড়াল হইতে অনেকবার দেখিয়ছি। দাদা অত্যন্ত অদ্ভুত লোক ছিলেন- পৃথিবীটাকে যেন ভালো করিয়া চোখ মেলিয়া দেখিতেন না। সংসারটা যেন তাহার পক্ষে যথেষ্ট ফাকা নয়- এইজন্য সরিয়া সরিয়া একেবারে প্রান্তে গিয়া আশ্রয় লইয়াছেন । ‘র্তাহার বন্ধুর মধ্যে এক শশিশেখর । এইজন্য বাহিরের যুবকদের মধ্যে আমি এই শশিশেখরকেই সর্বদা দেখিতাম। এবং যখন আমি সন্ধ্যাকালে পুষ্পতরুতলে সম্রাজ্ঞীর আসন গ্রহণ করিতাম তখন পৃথিবীর সমস্ত পুরুষজাতি শশিশেখরের মূর্তি ধরিয়া আমার চরণগত হইত।— শুনিতেছ? কী মনে হইতেছে।” আমি সনিশ্বাসে বলিলাম, ‘মনে হইতেছে, শশিশেখর হইয়া জন্মিলে বেশি হইত ।” “আগে সবটা শোনো । একদিন বাদলার দিনে আমার জ্বর হইয়াছে। ডাক্তার দেখিতে আসিয়াছেন । সেই প্ৰথম দেখা । ‘আমি জানালার দিকে মুখ করিয়াছিলাম, সন্ধ্যার লাল আভাটা পড়িয়া রুগণ মুখের বিবর্ণিতা যাহাতে দূর হয় । ডাক্তার যখন ঘুরে ঢুকিয়াই আমার মুখের দিকে একবার চাহিলেন তখন আমি মনে মনে ডাক্তার হইয়া কল্পনায় নিজের মুখের দিকে চাহিলাম। সেই সন্ধ্যালোকে কোমল বালিশের উপরে একটি ঈষৎক্লিষ্ট কুসুমপেলাব মুখ ; অসংযমিত চুর্ণকুন্তল ললাটের উপর আসিয়া পড়িয়াছে এবং লজ্জায় আনমিত বড়ো বড়ো চোখের পল্লব কপোলের উপর ছায়া বিস্তার করিয়াছে । ‘ডাক্তার নম্র মৃদুস্বরে দাদাকে বলিলেন, একবার হাতটা দেখিতে হইবে । “আমি গাত্রাবরণের ভিতর হইতে ক্লান্ত সুগোল হাতখানি বাহির করিয়া দিলাম। একবার হাতের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, যদি নীলবৰ্ণাৰ্কাচের চুড়ি পরিতে পারিতাম তো আরো বেশ মানাইত। রোগীর হাত লইয়া নাড়ী দেখিতে ডাক্তারের এমন ইতস্তত ইতিপূর্বে কখনো দেখি নাই। অত্যন্ত অসংলগ্নভাবে কম্পিত অঙ্গুলিতে নাড়ী দেখিলেন। তিনি আমার জ্বরের উত্তাপ বুঝিলেন, আমিও তাহার অন্তরের নাড়ী কিরূপ চলিতেছে কতকটা আভাস পাইলাম । বিশ্বাস হইতেছে না ?” আমি বলিলাম, “অবিশ্বাসের কোনো কারণ দেখিতেছি না- মানুষের নাড়ী সকল অবস্থায় সমান চলে कीं ।' ‘কালক্রমে আরো দুই-চারিবার রোগ ও আরোগ্য হইবার পরে দেখিলাম আমার সেই সন্ধ্যাকালের মানস-সভায় পৃথিবীর কোটি কোটি পুরুষ-সংখ্যা অত্যন্ত হ্রাস হইয়া ক্রমে একটিতে আসিয়া ঠেকিল, আমার পৃথিবী প্রায় জনশূন্য হইয়া আসিল । জগতে কেবল একটি ডাক্তার এবং একটি রোগী অবশিষ্ট রহিল। “আমি গোপনে সন্ধ্যাবেলায় একটি বাসষ্ঠী রঙের কাপড় পরিতাম, ভালো করিয়া খোপা বঁাধিয়া মাথায় একগাছি বেলফুলের মালা জড়াইতাম, একটি আয়না। হাতে লইয়া বাগানে গিয়া বসিতাম । ‘কেন । আপনাকে দেখিয়া কি আর পরিতৃপ্তি হয় না। বাস্তবিকই হয় না। কেননা আমি তো আপনি আপনাকে দেখিতাম না । আমি তখন একলা বসিয়া দুইজন হইতাম । আমি তখন ডাক্তার হইয়া আপনাকে দেখিতাম, মুগ্ধ হইতাম এবং ভালোবাসিতম এবং আদর করিতাম, অথচ প্ৰাণের ভিতরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস সন্ধ্যাবাতাসের মতো হু হু করিয়া উঠিত । “সেই হইতে আমি আর একলা ছিলাম না ; যখন চলিতাম নত নেত্ৰে চাহিয়া দেখিতাম পায়ের