পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ QS)。 ফকির শিশুজাতির প্রতি তিলমাত্র অনুরক্ত ছিলেন না- তাহাদিগকে তিনি কীট-পতঙ্গের ন্যায় দেহ হইতে দূরে রাখিতে ইচ্ছা করিতেন । সম্প্রতি তিনি অহরহ শিশু-পঙ্গপালে। আচ্ছন্ন হইয়া বৰ্জাইস অক্ষরের ছোটাে বড়ো নোটের দ্বারা আদ্যোপান্ত সমাকীর্ণ ঐতিহাসিক প্রবন্ধের ন্যায় শোভমান হইলেন । তাহদের মধ্যে বয়সের বিস্তর তারতম্য ছিল এবং তাহারা সকলেই কিছু তাহার সহিত বয়ঃপ্রাপ্ত সভ্যজনোচিত ব্যবহার করিত না ; শুদ্ধাশুচি ফকিরের চক্ষে অনেক সময় অশ্রণীর সঞ্চার হইত এবং তাহা আনন্দাশ্রু নহে । পরের ছেলেরা যখন নানা সুরে তঁহাকে “বাবা” “বাবা’ করিয়া ডাকিয়া আদর করিত তখন তাহার সাংঘাতিক পাশব শক্তি প্রয়োগ করিবার একান্ত ইচ্ছা হইত, কিন্তু ভয়ে পারিতেন না। মুখ চক্ষু বিকৃত করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতেন । অবশেষে ফকির মহা চেঁচামেচি করিয়া বলিতে লাগিল, “আমি যাবই, দেখি আমাকে কে আটক করিতে পারে ।” তখন গ্রামের লোক এক উকিল আনিয়া উপস্থিত করিল ! উকিল আসিয়া কহিল, ‘জানেন আপনার দুই it a ফকির । আজ্ঞে, এখানে এসে প্রথম জানলুম। উকিল । আর, আপনার সাত মেয়ে, এক ছেলে, তার মধ্যে দুটি মেয়ে বিবাহযোগ্য । ফকির । আজ্ঞে, আপনি আমার চেয়ে ঢের বেশি জানেন দেখতে পাচ্ছি। উকিল । আপনার এই বৃহৎ পরিবারের ভরণপোষণের ভার আপনি যদি না নেন। তবে আপনার অনাথিনী দুই স্ত্রী আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করবেন, পূর্বে হতে বলে রাখলুম। ফকির সব চেয়ে আদালতকে ভয় করিত | তাহার জানা ছিল, উকিলেরা জেরা করিবার সময় মহাপুরুষদিগের মানমর্যাদা গাভীর্যকে খাতির করে না- প্রকাশ্যে অপমান করে এবং খবরের কাগজে তাহার রিপোর্ট বাহির হয় । ফকির অশ্রুসিক্তলোচনে উকিলকে বিস্তারিত আত্মপরিচয় দিতে চেষ্টা করিল ; উকিল তাহার চাতুরীর, তাহার উপস্থিতবুদ্ধির, তাহার মিথ্যা-গল্প-রচনার অসাধারণ ক্ষমতার ভূয়োভূয়ঃ প্ৰশংসা করিতে লাগিল । শুনিয়া ফকিরের আপনি হস্তপদ দংশন করিতে ইচ্ছা করিতে লাগিল । ষষ্ঠীচরণ। ফকিরকে পুনশ্চ পলায়নোদ্যত দেখিয়া শোকে অধীর হইয়া পড়িল । পাড়ার লোকে তাহাকে চারি দিকে ঘিরিয়া অজস্র গালি দিল এবং উকিল তাহাকে এমন শাসাইল যে তাহার মুখে আর কথা রহিল। r ইহার উপর যখন আটজন বালক বালিকা গাঢ় স্নেহে তাহাকে চারি দিকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিয়া তাহার শ্বাসরোধ করিবার উপক্ৰম করিল, তখন অন্তরালস্থিত হৈমবতী হাসিবে কি কঁদিবে ভাবিয়া পাইল না । ফকির অন্য উপায় না দেখিয়া ইতিমধ্যে নিজের পিতাকে একখানা চিঠি লিখিয়া সমস্ত অবস্থা নিবেদন করিয়াছিল । সেই পত্ৰ পাইয়া ফকিরের পিতা হরিচরণবাবু আসিয়া উপস্থিত । পাড়ার লোক, জমিদার এবং উকিল কিছুতেই দখল ছাড়ে না । এ লোকটি যে ফকির নহে, মাখন, তাহারা তাহার সহস্ৰ অকাট্য প্রমাণ প্রয়োগ করিল- এমন-কি, যে ধাত্রী মাখনকে মানুষ করিয়াছিল। সেই বুড়িকে আনিয়া হাজির করিল। সে কম্পিত হন্তে ফকিরের চিবুক তুলিয়া ধরিয়া মুখ নিরীক্ষণ করিয়া তাহার দাড়ির উপরে দরবিগলিত ধারায় অশ্রুপাত করিতে লাগিল । যখন দেখিল, তাহাতেও ফকির রাশ মানে না, তখন ঘোমটা টানিয়া দুই স্ত্রী আসিয়া উপস্থিত হইল । পাড়ার লোকেরা শশব্যস্ত হইয়া ঘরের বাহিরে চলিয়া গেল । কেবল দুই বাপ, ফকির এবং শিশুরা ঘরে রহিল । RGRIN ” ফকির তাহা নির্দিষ্ট করিয়া বলিতে পারিল না, সুতরাং নিরুত্তর হইয়া রহিল। কিন্তু, ভাবে যেরূপ প্ৰকাশ পাইল তাহাতে যমের কোনো বিশেষ দ্বারের প্রতি তাহার যে বিশেষ পক্ষপাত আছে। এরূপ বোধ হইল না ; আপাতত যে-কোনো একটা দ্বারা পাইলেই সে বঁাচে, কেবল একবার বাহির হইতে পারিলেই হয় ।