পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন @g为 কিন্তু এইখানে এসেই যে সমস্ত ফুরোয়, তা নয় । এর থেকেও বেরোবার দরজা আছে । সেই দরজা যখন খুলে যায়। তখন দেখি আরো আছে, এবং তার মধ্যে শৈশব যৌবন বার্ধক্য সমস্তই অপূর্বভাবে সম্মিলিত । জীবন যখন ঝর্নার মতো করছিল তখন সে ঝর্নারূপেই সুন্দর, যখন নদী হয়ে বেরোল তখন সে নদীরূপেই সার্থক, যখন তার সঙ্গে চার দিক থেকে নানা উপনদী ও জলধারা এসে মিলে তাকে শাখাপ্ৰশাখায় ব্যাপ্ত করে দিলে তখন মহানন্দরাপেই তার মহত্ত্ব- তার পরে সমুদ্রে এসে যখন সে সংগত হল। তখন সেই সাগরসংগমেও তার মহিমা । বাল্যজীবন যখন ইন্দ্ৰিয়বোধের বাইরের ক্ষেত্র ছিল তখনো সে সুন্দর, যৌবন যখন ভাববোধের মানসক্ষেত্রে গেল। তখনো সে সুন্দর, প্রৌঢ় যখন বাহির ও অন্তরের সন্মিলনক্ষেত্রে গেল। তখনো সে সুন্দর এবং বৃদ্ধ যখন বাহির ও অন্তরের অতীত ক্ষেত্রে গেল। তখনো সে সুন্দর। আমার তরুণ বন্ধুর জন্মদিনে এই কথাই আমি চিন্তা করছি। আমি দেখছি, তিনি একটি বয়ঃসন্ধিতে দাড়িয়েছেন- তার সামনে একটি অভাবনীয় তাকে নব নব প্ৰত্যাশার পথে আহবান করছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, পঞ্চাশে পদার্পণ করে আমার সামনেও সেই অভাবনীয়কেই দেখছি। নূতন আর কিছুই নেই, শক্তির পাথেয় শেষ হয়ে গেছে, পথের সীমায় এসে ঠেকেছি, এ কথা কোনোমতেই বলতে পারছি নে। আমি তো দেখছি, আমিও একটি বিপুল বয়ঃসন্ধিতে দাড়িয়েছি। বাল্যের জগৎ, যৌবনের জগৎ, যা পার হয়ে এসেছি বলে মনে করেছিলুম, এখন দেখছি, তার শেষ হয় নি- তাকেই আবার আর-এক আলোকে আর-এক অর্থে আর-এক সুরে লাভ করতে হবে, মনের মধ্যে সেই একটি সংবাদ e এর মধ্যে অদ্ভুত ব্যাপারটা এই যে, যেখানে ছিলুম। সেইখানেই আছি। অথচ চলেওছি। শিশুকালের যে-পৃথিবী, যে-চন্দ্ৰসূৰ্যতারা, এখনো তাই- স্থানপরিবর্তন করতে হয় নি, অথচ সমস্তই বেড়ে উঠেছে। দাশুরায়ের পাঁচালি যে পড়বে তাকে যদি কোনোদিন কালিদাসের কাব্য পড়তে হয়, তবে তাকে স্বতন্ত্র পুঁথি খুলতে হয়। কিন্তু এ জগতে একই পুঁথি খোলা রয়েছে- সেই পুঁথিকে শিশু পড়ছে ছড়ার মতো, যুবা পড়ছে কাব্যের মতো এবং বৃদ্ধ তাতেই পড়ছে ভাগবত । কাউকে আর নড়ে বসতে হয় নি- কাউকে এমন কথা বলতে হয় নি যে, “এ জগতে আমার চলবে না, আমি একে ছাড়িয়ে গেছি- আমার জন্যে নূতন জগতের দরকার ।” কিছুই দরকার হয় না। এইজন্যে যে, যিনি এ পুঁথি পড়াচ্ছেন তিনি অনন্ত নুতন- তিনি আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত পাঠকে নুতন করে নিয়ে চলেছেন- মনে হচ্ছে না যে, কোনো পড়া সাঙ্গ হয়ে গেছে। এইজন্যেই পড়ার প্রত্যেক অংশেই আমরা সম্পূর্ণতাকে দেখতে পাচ্ছি- মনে হচ্ছে, এই যথেষ্ট-- মনে হচ্ছে, আর দরকার নেই। ফুল যখন ফুটেছে তখন সে এমনি করে ফুটছে যেন সেই চরম ; তার মধ্যে ফলের আকাঙ্ক্ষা দৈন্যরূপে যেন নেই। তার কারণ হচ্ছে, পরিণত ফলের মধ্যে র্যাের আনন্দ অপরিণত ফুলের মধ্যেও তার আনন্দের অভাব নেই । শৈশবে যখন ধুলোবালি নিয়ে, যখন নুড়ি শামুক ঝিনুক ঢেলা নিয়ে খেলা করেছি, তখন বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের অনাদিকালের ভগবান শিশুভগবান হয়ে আমাদের সঙ্গে খেলা করেছেন । তিনি যদি আমাদের সঙ্গে শিশু না হতেন এবং তার সমস্ত জগৎকে শিশুর খেলাঘর করে না তুলতেন, তা হলে তুচ্ছ ধুলোমাটি আমাদের কাছে এমন আনন্দময় হয়ে উঠত না । তিনি আমাদের সঙ্গে থেকে আমাদের মতো হয়ে আমাদের আনন্দ দিয়ে এসেছেন, এইজন্যে শিশুর জীবনের সেই পরিপূর্ণস্বরূপের লীলাই এমন সুন্দর হয়ে দেখা দেয় ; কেউ তাকে ছোটাে বলে মুঢ় বলে, অক্ষম বলে অবজ্ঞা করতে পারে না— অনন্ত শিশু তার সখা হয়ে তাকে এমনি গীেরবান্বিত করে তুলেছেন যে, জগতের আদরের সিংহাসন সে অতি অনায়াসেই অধিকার করে বসেছে, কেউ তাকে বাধা দিতে সাহস করে না । আবার সেইজন্যেই আমার উনিশ বৎসরের যুবা বন্ধুর তারুণ্যকে আমি অবজ্ঞা করতে পারি। নে । যিনি চিরযুবা তিনি তাকে যৌবনে মণ্ডিত জগতের মাঝখানে হাতে ধরে দাড় করিয়ে দিয়েছেন। চিরকাল ধরে কত যুবাকেই যে তিনি যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করে এনেছেন, তার আর সীমা নেই। তাই যৌবনের মধ্যে চরমের