পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন ○ ケ> পড়েছি, সকলের সঙ্গে আজ আমাদের নানাপ্রকার ব্যবহারে আসতে হয়েছে। আজ আমাদের যেখানে চরিত্রের দীনতা, জ্ঞানের সংকীর্ণতা, হৃদয়ের সংকোচ, যেখানে যুক্তিহীন আচারের দ্বারা আমাদের । শক্তিপ্রয়োগের পথ পদে পদে বাধাগ্ৰস্ত হয়ে উঠছে, যেখানেই লোকব্যবহারে ও দেবতার উপাসনায় মানুষের সঙ্গে মানুষের দুর্ভেদ্য ব্যবধানে আমাদের শতখণ্ড করে দিচ্ছে, সেইখানেই আমাদের আঘাতের পর আঘাত, লজ্জার পর লজ্জা পেতে হচ্ছে- সেইখানেই অকৃতাৰ্থতা বারংবার আমাদের সমস্ত চেষ্টাকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে এবং সেইখানেই প্রবলবেগে চলনশীল মানবস্রোতের অভিঘাত সহ্য করতে না পেরে আমরা মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে যাচ্ছি- এইরকম সময়েই যে-সকল মহাপুরুষ আমাদের দেশে মঙ্গলের জয়ধ্বজ বহন করে আবির্ভূত হবেন তাদের ব্রতই হবে জীবনের সাধনার ও সিদ্ধির মধ্যে সত্যের সেই বৃহৎ সামঞ্জস্যকে সমুজ্জ্বল করে তোলা যাতে করে এখানকার জনসমাজের সেই সাংঘাতিক বিশ্লিষ্টতা দূর হবে- যে বিশ্লিষ্টতা এ দেশে সঙ্গে মানুষের প্রবল বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আমাদের মনুষ্যত্বকে শতজীর্ণ করে ফেলছে । ধনীগৃহের প্রচুর বিলাসের আয়োজনের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে এবং আচারনিষ্ঠ সমাজে কুলক্ৰমাগত প্রথার ; মধ্যে পরিবেষ্টিত হয়ে মহর্ষি নিজের বিচ্ছেদকাতর আত্মার মধ্যে এই সামঞ্জস্য-অমৃতের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন ; নিজের জীবনে চিরদিন সমস্ত লাভক্ষতি সমস্ত সুখদুঃখের মধ্যে এই সামঞ্জস্যের সাধনাকে গ্ৰহণ করেছিলেন এবং বাহিরে সমস্ত বাধাবিরোধের মধ্যে “শান্তংশিবমদ্বৈতম। এই সামঞ্জস্যের মন্ত্রটি অকুষ্ঠিত কণ্ঠে প্রচার করেছিলেন । তার জীবনের অবসান পর্যন্ত এই দেখা গেছে যে তার চিত্ত কোনো বিষয়েই নিশ্চেষ্ট ছিল না— ঘরে বাইরে, শয়নে আসনে, আহারে ব্যবহারে, আচারে অনুষ্ঠানে, কিছুতেই তার লেশমাত্র শৈথিল্য বা অমনোযোগ ছিল না। কি গৃহকর্মে কি বিষয়কৰ্মে, কি সামাজিক ব্যাপারে, কি ধর্মানুষ্ঠানে, সুনিয়মিত ব্যবস্থার স্বলন তিনি কোনো কারণেই অল্পমাত্রও স্বীকার করতেন না ; সমস্ত ব্যাপারকেই তিনি ধ্যানের মধ্যে সমগ্রভাবে দেখতেন এবং একেবারে সর্বাঙ্গীণভাবে সম্পন্ন করতেন- তুচ্ছ থেকে বৃহৎ পর্যন্ত যা-কিছুর সঙ্গে তার যোগ ছিল তার কোনাে অংশেই তিনি নিয়মের ব্যভিচার ও সৌন্দর্যের বিকৃতি সহ্য করতে পারতেন না । ভাষায় বা ভাবে বা ব্যবহারে কিছুমাত্র ওজন নষ্ট হলে তৎক্ষণাৎ তাকে আঘাত করত । র্তার মধ্যে যে দৃষ্টি, যে ইচ্ছা, যে আধ্যাত্মিক শক্তি ছিল তা ছােটােবড়ো এবং আন্তরিক বাহ্যিক কিছুকেই বাদ দিত না, সমস্তকেই ভাবের মধ্যে মিলিয়ে নিয়মের মধ্যে বেঁধে কাজের মধ্যে সম্পন্ন করে তুলে তবে স্থির হতে পারত। তার জীবনের অবসানপর্যন্ত দেখা গেছে, তার ব্ৰহ্মসাধনা প্ৰাকৃতিক ও মানবিক কোনো বিষয়কেই অবজ্ঞা করে নি- সর্বত্রই তার ঔৎসুক্য অক্ষুন্ন ছিল । বাল্যকালে আমি যখন তার সঙ্গে ডালহৌসি পর্বতে একবার গিয়েছিলুম তখন দেখেছিলুম এক দিকে যেমন তিনি অন্ধকার রাত্রে শয্যাত্যাগ করে পার্বত্য গৃহের বারান্দায় একাকী উপাসনার আসনে বসতেন, ক্ষণে ক্ষণে উপনিষৎ ও ক্ষণে ক্ষণে হাফেজের গান গেয়ে উঠতেন, দিনের মধ্যে থেকে থেকে ধ্যানে নিমগ্ন হতেন, সন্ধ্যাকালে আমার বালককণ্ঠের ব্ৰহ্মসংগীত শ্রবণ করতেন- তেমনি আবার জ্ঞান-আলোচনার সহায়স্বরূপ তার সঙ্গে প্ৰক্টরের তিনখানি জ্যোতিষ্ক সম্বন্ধীয় বই, কান্টের দর্শন ও গিবনের “রোমের ইতিহাস’ ছিল— তা ছাড়া এদেশের ও ইংলন্ডের সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্ৰ হতে তিনি জ্ঞানে ও কর্মে বিশ্বপূথিবীতে মানুষের যা-কিছু পরিণতি ঘটছে, সমস্তই মনে মনে পর্যবেক্ষণ করতেন । তার চিত্তের এই সর্বব্যাপী সামঞ্জস্যবোধ তাকে তার সংসার যাত্রায় ও ধর্মেকর্মে সর্বপ্রকার সীমালঙ্ঘন হতে নিয়ত রক্ষা করেছে— গুরুবাদ ও অবতারবাদের উদ্ধৃঙ্খলতা হতে র্তাকে নিবৃত্ত করেছে। এবং এই সামঞ্জস্যবোধ চিরন্তন সঙ্গীরূপে তাকে একান্ত দ্বৈতবাদের মধ্যে পথভ্ৰষ্ট বা একান্ত অদ্বৈতবাদের কুহেলিকারাজ্যে নিরুদ্দেশ হতে দেয় নি। এই সীমালঙ্ঘনের আশঙ্কা তার মনে সর্বদা কিরকম জাগ্রত ছিল, তার একটি উদাহরণ দিয়ে আমি শেষ করব। তখন তিনি অসুস্থ শরীরে পার্ক স্ট্রীটে বাস করতেন- একদিন মধ্যাহ্নে আমাদের জোড়ার্সাকোর বাটি থেকে তিনি আমাকে পার্ক স্ত্রীটে ডাকিয়ে নিয়ে বললেন, “দেখো, আমার মৃত্যুর পরে আমার চিতাভস্ম নিয়ে শান্তিনিকেতনে সমাধি স্থাপনের একটি প্রস্তাব আমি শুনেছি ; কিন্তু তোমার কাছে আমি বিশেষ করে বলে যাচ্ছি, কদাচ সেখানে আমার সমাধিরচনা করতে দেবে না৷ ”- আমি বেশ বুঝতে পারলুম, শান্তিনিকেতন আশ্রমের যে ধ্যানমূর্তি র্তাব মনের মধ্যে বিরাজ করছিল, সেখানে