পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

¢br&ይ রবীন্দ্র-রচনাবলী মুহুর্তেই বিশ্বজগতের শতসহস্ৰ নিয়মকে প্রাণপণে মানতে হচ্ছে বটে, কিন্তু সেই মেনে চলবার চেষ্টাতেই আমাদের শক্তির মধ্যে আনন্দের ঢেউ খেলিয়ে উঠছে। দায়ও যেমন কঠোর, খুশিও তেমনি প্ৰবল । সেই আমাদের ওস্তাদের হাতে বাজবার সুবিধেই হচ্ছে ঐ । তিনি সব সুরের রাগিণীই জানেন । যে-কটি তার বাধা হচ্ছে, তাতে যে-কটি সুর বাজে, কেবলমাত্র সেই কটি নিয়েই তিনি রাগিণী ফলিয়ে তুলতে পারেন। পাপী হােক, মূঢ় হােক ; স্বার্থপর হােক, বিষয়ী হােক, যে হােক-না, বিশ্বের আনন্দের একটা সুরও বাজে না এমন চিত্ত কোথায় । তা হলেই হল ; সেই সুযোগটুকু পেলেই তিনি আর ছাড়েন না । আমাদের অসাড়তমেরও হৃদয়ে প্রবল ঝনঝনার মাঝখানে হঠাৎ এমন একটা কিছু সুর বেজে ওঠে যার যোগে ক্ষণকালের জন্যে নিজের চার দিককে ছাড়িয়ে গিয়ে চিরন্তনের সঙ্গে মিলে যাই। এমন একটা-কোনো সুর, নিজের প্রয়োজনের সঙ্গে অহংকারের সঙ্গে যার মিল নেই- যার মিল আছে আকাশের নীলিমার সঙ্গে, প্ৰভাতের আলোর সঙ্গে ; যার মিল আছে ত্যাগীর ত্যাগের সঙ্গে, বীরের অভয়ের সঙ্গে, সাধুর প্রসন্নতার সঙ্গে ; সেই সুরটি যখন বাজে তখন মায়ের কোলের অতিক্ষুদ্র শিশুটিও আমাদের সকল স্বার্থের উপরে চেপে বসে ; সেই সুরেই আমরা ভাইকে চিনি, বন্ধুকে টানি, দেশের কাজে প্ৰাণ দিই। ; সেই সুরে সত্য আমাদের দুঃসাধ্য সাধনের দুৰ্গমপথে অনায়াসে আহবান করে ; সেই সুর যখন বেজে ওঠে তখন আমরা জন্মদারিদ্রের এই চিরাভ্যস্ত কথাটা মুহুর্তেই ভুলে যাই যে, আমরা ক্ষুধাতৃষ্ণার জীব, আমরা জন্মমরণের অধীন, আমরা স্তুতিনিন্দায় আন্দোলিত ; সেই সুরের স্পন্দনে আমাদের সমস্ত ক্ষুদ্র সীমা স্পন্দিত হয়ে উঠে আপনাকে লুকিয়ে অসীমকেই প্রকাশ করতে থাকে। সে সুর যখন বাজে না তখন আমরা ধূলির ধূলি, আমরা প্ৰকৃতির অতিভীষণ প্ৰকাণ্ড যন্ত্রটার মধ্যে আবদ্ধ একটা অত্যন্ত ক্ষুদ্র চাকা, কার্যকারণের শৃঙ্খলে আষ্ট্রেপৃষ্ঠে জড়িত । তখন বিশ্বজগতের কল্পনাতীত বৃহত্ত্বের কাছে আমাদের ক্ষুদ্র আয়তন লজ্জিত, বিশ্বশক্তির অপরিমেয় প্রবলতার কাছে আমাদের ক্ষুদ্র শক্তি কুষ্ঠিত । তখন আমরা মাথা হেঁট করে দুই হাত জোড় করে বলে যখন-তখন যেখানে-সেখানে প্ৰণাম করে করে বেড়াই । তখন আমাদের সংকল্প সংকীর্ণ, আমাদের আশা ছোটো, আকাঙক্ষা ছোটো, বিশ্বাস ছোটো, আমাদের আরাধ্য দেবতাও ছোটো । তখন কেবল “খাও— পরো— সুখে থাকো— হেসে খেলে দিন কাটাও’ এইটেই আমাদের জীবনের মন্ত্র । কিন্তু সেই ভুমার সুর যখনই বৃহৎ আনন্দের রাগিণীতে আমাদের আত্মার মধ্যে মন্দ্রিত হয়ে ওঠে, তখনই কার্যকারণের শৃঙ্খলে বাধা থেকেও আমরা তার থেকে মুক্ত হই, তখন আমরা প্ৰকৃতির অধীন থেকেও অধীন নাই, প্ৰকৃতির অংশ হয়েও তার চেয়ে বড়ো ; তখন আমরা জগৎসৌন্দর্যের দর্শক, জগৎঐশ্বর্যের অধিকারী, জগৎপতির আনন্দভাণ্ডারের অংশী- তখন আমরা প্রকৃতির বিচারক, প্রকৃতির স্বামী । আজ বাজুক ভূমানন্দের সেই মেঘমন্দ্র সুন্দর ভীষণ সংগীত যাতে আমরা নিজেকে নিজে অতিক্রম করে অমৃতলোকে জাগ্রত হই। আজ। আপনার অধিকারকে বিশ্বক্ষেত্রে প্রশস্ত করে দেখি, শক্তিকে বিশ্বশক্তির সহযোগী করে দেখি, মর্তজীবনকে অনন্তজীবনের মধ্যে বিধৃতরূপে ধ্যান করি । বাজে বাজে জীবনবীণা বাজে ! কেবল আমার একলার বীণা নয়- লোকে লোকে জীবনবীণা বাজে । কত জীব, তার কত রূপ, তার কত ভাষা, তার কত সুর, কত দেশে, কত কালে- সব মিলে অনন্ত আকাশে বাজে বাজে জীবনবীণা বাজে। রূপ-রস-শব্দ-গন্ধের নিরস্তর আন্দোলনে, সুখদুঃখের জন্মমৃত্যুর আলোক-অন্ধকারের নিরবচ্ছিন্ন আঘাত-অভিঘাতে, বাজে বাজে জীবনবীণা বাজে। ধন্য আমার প্রাণ যে, সেই অনন্ত আনন্দসংগীতের মধ্যে আমারও সুরটুকু জড়িত হয়ে আছে ; এই আমিটুকুর তান সকল-আমির গানে সুরের পর সুর জুগিয়ে মিড়ের পর মিড় টেনে চলেছে। এই আমিটুকুর তান কত সূর্যের আলোয় বাজছে, কত লোকে লোকে জন্মমরণের পর্যায়ের মধ্য দিয়ে বিস্তীর্ণ হচ্ছে, কত নব নব নিবিড় বেদনার মধ্য দিয়ে অভাবনীয় রূপে বিচিত্র হয়ে উঠছে ; সকল-আমির বিশ্বব্যাপী বিরাট বীণায় এই আমি এবং আমার মতো এমন কত আমির তার আকাশে আকাশে ঝংকৃত হয়ে উঠছে। কী সুন্দর আমি !! কী মহৎ আমি !! কী সার্থক আমি ! আজ আমাদের সাম্বাৎসরিক উৎসবের দিনে আমাদের সমস্ত মনপ্রাণকে বিশ্বলোকের মাঝখানে উন্মুখ