পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ነbrb” রবীন্দ্র-রচনাবলী আশার অন্ত নেই- আমরা মানব না পরাভব, আমরা জানিব না অবসাদ, আমরা করব না। আত্মার অবমাননা, চলাব দৃঢ়পদে অসংকুচিত চিত্তে— চলাব সমস্ত সুখদুঃখের উপর দিয়ে, সমস্ত স্বাৰ্থ এবং দৈন্য এবং জড়তাকে দলিত করে- তোমার বিশ্বলোকে অনাহত তুরীতে জয়বাদ্য বাজতে থাকবে, চারি দিক থেকে আহবান আসতে থাকবে ‘এসো, এসো, এসো- আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে খুলে যাবে চিরজীবনের সিংহদ্বারকল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ— অস্তরে বাহিরে কল্যাণ— আনন্দম, আনন্দম, পরিপূর্ণমানন্দম। ఇ (R SDSQ SV কর্মযোগ জগতে আনন্দ যজ্ঞে তার যে নিমন্ত্রণ আমরা আমাদের জীবনের সঙ্গে সঙ্গেই পেয়েছি তাকে আমাদের কেউ কেউ স্বীকার করতে চাচ্ছে না । তারা বিজ্ঞানশাস্ত্ৰ আলোচনা করে দেখেছে । তারা বিশ্বের সমস্ত রহস্য উদঘাটন করে এমন একটা জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যেখানে সমস্তই কেবল নিয়ম । তারা বলছে ফাকি ধরা পড়ে গেছে- দেখছি। যা-কিছু সব নিয়মেই চলেছে, এর মধ্যে আনন্দ কোথায় ? তারা আমাদের উৎসবের আনন্দরব শুনে দূরে বসে মনে মনে হাসছে। সূৰ্য চন্দ্র এমনি ঠিক নিয়মে উঠছে, অস্ত যাচ্ছে, যে, মনে হচ্ছে তারা যেন ভয়ে চলছে, পাছে এক পল-বিপলেরও ক্রটি ঘটে । বাতাসকে বাইরে থেকে যতই স্বাধীন বলে মনে হয়, যারা ভিতরকার খবর রাখে। তারা জানে, ওর মধ্যেও পাগলামির কিছুই নেই- সমস্তই নিয়মে বাধা । এমন-কি, পৃথিবীতে সব চেয়ে খামখেয়ালি বলে যাকে মনে হয় সেই মৃত্যু, যার আনাগোনার কোনো খবর পাই নে বলে যাকে হঠাৎ ঘরের দরজার সামনে দেখে আমরা চমকে উঠি, তাকেও জোড়হাতে নিয়ম পালন করে চলতে হয়— একটুও পদস্থলন হবার জো নেই । মনে কোরো না। এই গৃঢ় খবরটা কেবল বৈজ্ঞানিকের কাছেই ধরা পড়েছে। তপোবনের ঋষি বলেছেন : ভীষাম্মাদবাতঃ পবতে। তার ভয়ে, তার নিয়মের অমোঘ শাসনে বাতাস বইছে ; বাতাসও মুক্ত নয় । ভীষাম্মদগ্নিশ্চেন্দ্ৰশ্চ মৃত্যুৰ্ধাবতি পঞ্চমঃ । তার নিয়মের অমোঘ শাসনে কেবল যে অগ্নি চন্দ্ৰ সূৰ্য চলছে তা নয়, স্বয়ং মৃত্যু, যে কেবল বন্ধন কাটাবার জন্যেই আছে, যার নিজের কোনো বন্ধন আছে বলে মনেও হয় না, সেও অমোঘ নিয়মকে একান্ত ভয়ে পালন করে চলছে। তবে তো দেখছি ভয়েই সমস্ত চলছে, কোথাও একটু ফাক নেই। তবে আর আনন্দের কথাটা কেন ? যেখানে কারখানাঘরে আগাগোড়া কল চলছে সেখানে কোনো পাগল আনন্দের দরবার করতে যায় না । বঁশিতে তবু তো আজ আনন্দের সুর উঠেছে, এ কথা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। মানুষকে তো মানুষ এমন করে ডাকে, বলে, চল ভাই, আনন্দ করবি চল। এই নিয়মের রাজ্যে এমন কথাটা তার মুখ দিয়ে বের হয় কেন । সে দেখতে পাচ্ছে, নিয়মের কঠিন দণ্ড একেবারে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ; কিন্তু তাকে জড়িয়ে জড়িয়ে তাকে আচ্ছন্ন করে যে লতাটি উঠেছে তাতে কি আমরা কোনাে ফুল ফুটতে দেখি নি ? দেখিনি কি কোথাও শ্ৰী এবং শান্তি, সৌন্দর্য এবং ঐশ্বৰ্য ? দেখছি নে কি প্রাণের লীলা, গতির নৃত্য, বৈচিত্র্যের VeršNO 2 বিশ্বের নিয়ম সোজা হয়ে দাড়িয়ে নিজেকেই চরম রূপে প্রচার কােয়ছে না- একটি অনির্বাচনীয়ের পরিচয় তাকে চারি দিকে আচ্ছন্ন করে প্রকাশ পাচ্ছে । সেইজন্যেই যে উপনিষৎ একবার বলেছেন “অমোঘ শাসনের ভয়ে যা-কিছু সমস্ত চলেছে। তিনিই আবার বলেছেন : আনন্দান্ধেব খঘিমানি ভূতানি জায়ন্তে। আনন্দ থেকেই এই যা-কিছু সমস্ত জন্মাচ্ছে। যিনি আনন্দস্বরূপ, মুক্ত, তিনিই নিয়মের বন্ধনের মধ্য দিয়ে দেশকালে আপনাকে প্ৰকাশ করছেন ।