পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Gove রবীন্দ্র-রচনাবলী আত্মবোধ কয়েকদিন হল পল্লীগ্রামে কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের দুইজন বাউলের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলুম, “তোমাদের ধর্মের বিশেষত্বটি কী আমাকে বলতে পাের ?” একজন বললে, “বলা বড়ো কঠিন, ঠিক বলা যায় না।” আর-একজন বললে, “বলা যায় বৈকি— কথাটা সহজ । আমরা বলি এই যে, গুরুর উপদেশে গোড়ায় আপনাকে জানতে হয় । যখন আপনাকে জানি তখন সেই আপনার মধ্যে তাকে পাওয়া যায়।” আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “তোমাদের এই ধর্মের কথা পৃথিবীর লোককে সবাইকে শোনাও না কেন।” সে বললে, “যার পিপাসা হবে সে গঙ্গার কাছে আপনি আসবে।” আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “তই কি দেখতে পাচ্ছি। কেউ কি আসছে।” সে লোকটি অত্যন্ত প্ৰশান্ত হাসি হেসে বললে, “সবাই আসবে। সবাইকে আসতে হবে ।” আমি এই কথা ভাবলুম, বাংলাদেশের পল্লীগ্রামের শাস্ত্ৰশিক্ষাহীন এই বাউল, এ তো মিথ্যা বলে নি । আসছে, সমস্ত মানুষই আসছে। কেউ তো স্থির হয়ে নেই। আপনার পরিপূর্ণতার অভিমুখেই তো সবাইকে চলতে হচ্ছে, আর যাবে কোথায় । আমরা প্ৰসন্নমনে হাসতে পারি— পৃথিবী জুড়ে সবাই যাত্রা করেছে। আমরা কি মনে করছি। সবাই কেবল নিজের উদর-পূরণের অন্ন খুঁজছে, নিজের প্রাত্যহিক প্রয়োজনের চারি দিকেই প্ৰতিদিন প্ৰদক্ষিণ করে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে ? না, তা নয়। এই মুহুর্তেই পৃথিবীর সমস্ত মানুষ অন্নের জন্যে, বিস্ত্রের জন্যে, নিজের ছোটো বড়ো কত শত দৈনিক আবশ্যকের জন্যে ছুটে বেড়াচ্ছে- কিন্তু, কেবল তার সেই আহিক গতিতে নিজেকে প্ৰদক্ষিণ করা নয়, সেই সঙ্গে সঙ্গেই সে জেনে এবং না জেনে একটি প্ৰকাণ্ড কক্ষে মহাকাশে আর-একটি কেন্দ্রের চার দিকে যাত্রা করে চলেছে— যে কেন্দ্রের সঙ্গে সে জ্যোতির্ময় নাড়ির আকর্ষণে বিধৃত হয়ে রয়েছে, যেখান থেকে সে আলোক পাচ্ছে, প্ৰাণ পাচ্ছে, যার সঙ্গে একটি অদৃশ্য অথচ অবিচ্ছেদ্য সূত্রে তার চিরদিনের মহাযোগ রয়েছে। মানুষ অন্নবস্ত্রের চেয়ে গভীর প্রয়োজনের জন্যে পথে বেরিয়ে পড়েছে। কী সেই প্রয়োজন ? তপোবনে ভারতবর্ষের ঋষি তার উত্তর দিয়েছেন । এবং বাংলাদেশের পল্লীগ্রামে বাউলও তার উত্তর দিচ্ছে। মানুষ আপনাকে পাবার জন্যে বেরিয়েছে ; আপনাকে না পেলে, তার আপনার চেয়ে যিনি বড়ো আপনি তাকে পাবার জো নেই। তাই এই আপনাকেই বিশুদ্ধ করে, প্রবল করে, পরিপূর্ণ ক’রে পাবার জন্যে মানুষ কত তপস্যা করছে। শিশুকাল থেকেই সে আপনার প্রবৃত্তিকে শিক্ষিত ও সংযত করছে, এক-একটি বড়ো বড়ো লক্ষ্যের চার দিকে সে আপনার ছোটো ছোটো সমস্ত বাসনাকে নিয়মিত করবার চেষ্টা করছে, এমন-সকল আচার-অনুষ্ঠানের সে সৃষ্টি করছে যাতে তাকে অহরহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, দৈনিক জীবনযাত্রার মধ্যে তার সমাপ্তি নেই, সমাজব্যবহারের মধ্যেও তার অবসান নেই। সে এমন একটি বৃহৎ আপনাকে চাচ্ছে যে-আপনি তার বর্তমানকে, তার চার দিককে, তার প্রবৃত্তি ও বাসনাকে ছাড়িয়ে অনেকদূরে চলে গেছে। আমাদের বৈরাগী বাংলাদেশের একটি ছােটাে নদীর ধারে এক সামান্য কুটিরে বসে এই আপনির খোজ করছে এবং নিশ্চিন্ত হাস্যে বলছে, সবাইকেই আসতে হবে এই আপনির খোজ করতে। কেননা, এ তো কোনো বিশেষ মতের বিশেষ সম্প্রদায়ের ডাক নয় ; সমস্ত মানবের মধ্যে যে চিরন্তন সত্য আছে। এ যে তারই ডাক । কলরবের তো অন্ত নেই- কত কল-কারখানা, কত যুদ্ধবিগ্ৰহ, কত বাণিজ্য-ব্যবসায়ের কোলাহল আকাশকে মথিত করছে ; কিন্তু মানুষের ভিতর থেকে সেই সত্যের ডাককে কিছুতেই আচ্ছন্ন করতে পারছে না । মানুষের সমস্ত ক্ষুধাতৃষ্ণা সমস্ত অর্জন-বর্জনের মাঝখানে সে রয়েছে। কত ভাষায় সে কথা কইছে, কত কালে কত দেশে। কত রূপে কত ভাবে সমস্ত আশু প্ৰয়োজনের উপর সে জাগ্রত হয়ে আছে । কত তর্ক তাকে আঘাত করছে, কত সংশয় তাকে অস্বীকার করছে, কত বিকৃতি তাকে আক্রমণ করছে, কিন্তু সে বেঁচেই আছে । সে কেবলই বলছে, তোমার আপনিকে পাও : আত্মানং বিদ্ধি । এই আপনিকে মানুষ সহজে আপনি করে তুলতে পারছে না, সেইজন্যে মানুষ সূত্রচ্ছিন্ন মালার মতো কেবলই খসে যাচ্ছে, ধুলোয় ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু, যে বিশ্বজগতে সে নিশ্চিন্ত হয়ে বাস করছে সেই জগৎ তো মুহুর্মুহু এমন করে খসে পড়ছে না, ছড়িয়ে পড়ছে না ।