পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন VOCk তখন কর্মের আর অন্ত নেই, ত্যাগের আর সীমা নেই। তখন ভক্ত বিশ্ববোধের মধ্যে, বিশ্বপ্রেমের মধ্যে, বিশ্বসেবার মধ্যে আপনাকে ভুমার প্রকাশে প্রকাশিত করতে থাকে। ভক্তের জীবনের মধ্যে যখন সেই প্ৰকাশকে আমরা দেখি তখন কী দেখি ? দেখি, সে তর্কবিতর্ক নয়, সে তত্ত্বজ্ঞানের টীকাভাষ্য বাদপ্রতিবাদ নয়, সে বিজ্ঞান নয়, দর্শন নয়- সে একটি একের সম্পূর্ণতা, অখণ্ডতার পরিব্যক্তি । যেমন জগৎকে প্রত্যক্ষ অনুভব করবার জন্যে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাশালায় যাবার দরকার হয় না, সেও তেমনি । ভক্তের সমস্ত জীবনটিকে এক করে মিলিয়ে নিয়ে অসীম সেখানে একেবারে সহজরীপে দেখা দেন। তখন ভক্তের জীবনের সমস্ত বৈচিত্র্যের মধ্যে আর বিরুদ্ধতা দেখতে পাই নে । তার আগাগোড়াই সেই একের মধ্যে সুন্দর হয়ে, মহৎ হয়ে, শক্তিশালী হয়ে মেলে । জ্ঞান মেলে, ভক্তি মেলে, কর্ম মেলে । বাহির মেলে, অন্তর মেলে । কেবল যে সুখ মেলে তা নয়, দুঃখও মেলে । কেবল যে জীবন মেলে তা নয়, মৃত্যুও মেলে। কেবল যে বন্ধু মেলে তা নয়, শত্রুও মেলে । সমস্তই আনন্দে মিলে যায়, রাগিণীতে মিলে ওঠে । তখন জীবনের সমস্ত সুখদুঃখ বিপদসম্পদের পরিপূর্ণ সার্থকতা সুডোল হয়ে, নিটােল অবিচ্ছিন্ন হয়ে প্ৰকাশমান হয় । সেই প্রকাশেরই অনির্বচনীয় রূপ হচ্ছে প্রেমের রূপ । সেই প্রেমের রূপে সুখ এবং দুঃখ দুই’ই সুন্দর, ত্যাগ এবং ভোগ দুই’ই পবিত্র, ক্ষতি এবং লাভ দুই’ই সার্থক ; এই প্রেমে সমস্ত বিরোধের আঘাত, বীণার তারে অঙ্গুলির আঘাতের মতো, মধুর সুরে বাজতে থাকে। এই প্রেমের মৃদুতাও যেমন সুকুমার, বীরত্বও তেমনি সুকঠিন । এই প্রেম দূরকে এবং নিকটকে, আত্মীয়কে এবং পরকে, জীবনসমুদ্রের এ পারকে এবং ও পারকে প্রবল মাথুর্যে এক করে দিয়ে, দিগদিগন্তরের ব্যবধানকে আপনি বিপুল সুন্দর হাস্যের ছটায় পরাহত করে দিয়ে, উষার মতো উদিত হয় । অসীম তখন মানুষের নিতান্ত আপনার সামগ্ৰী হয়ে দেখা দেন পিতা হয়ে, বন্ধু হয়ে, স্বামী হয়ে, তার সুখদুঃখের ভাগী হয়ে, তার মনের মানুষ হয়ে । তখন অসীমে সসীমে যে প্ৰভেদ সেই প্ৰভেদ কেবলই অমৃতে ভরে ভরে উঠতে থাকে, সেই ফাকিটুকুর ভিতর দিয়ে মিলনের পারিজাত আপনার পাপড়ি একটির পর একটি করে বিকশিত করতে থাকে । তখন জগতের সকল প্ৰকাশ, সকল আকাশের সকল তারা, সকল ঋতুর সকল ফুল, সেই প্রকাশের উৎসবে বঁশি বাজাবার জন্যে ছুটে আসে। তখন হে রুদ্র, হে চিরদিনের পরম দুঃখ, হে চিরজীবনের বিচ্ছেদবেদনা, তোমার এ কী মূর্তি ! এ কী দক্ষিণং মুখম! তখন তুমি নিত্য পরিত্রণ করছ, সসীমতার নিত্য দুঃখ হতে নিত্য বিচ্ছেদ হতে তুমি নিত্যই পরিত্রাণ করে চলেছি- এই গৃঢ় কথা আর গোপন থাকে না । তখন ভক্তের উদঘাটিত হৃদয়ের ভিতর দিয়ে মানবলোকে তোমার সিংহদ্বার খুলে যায়। ছুটে আসে সমস্ত বালক বৃদ্ধ ; যারা মূঢ় তারাও বাধা পায় না, যারা পতিত তারাও নিমন্ত্রণ পায় । লোকাচারের কৃত্রিম শাস্ত্ৰবিধি টলমল করতে থাকে এবং শ্রেণীভেদের নিষ্ঠুর পাষাণপ্রাচীর করুণায় বিগলিত হয়ে পড়ে। তোমার বিশ্বজগৎ আকাশে এই কথাটা বলে বেড়াচ্ছে যে “আমি তোমার’ । এই কথা বলে সে নতশিরে তোমার নিয়ম পালন করে চলছে । মানুষ তার চেয়ে ঢের বড়ো কথা বলবার জন্য অনন্ত আকাশে মাথা তুলে দাড়িয়েছে। সে বলতে চায় “তুমি আমার । কেবল তোমার মধ্যে আমার স্থান তা নয়, আমার মধ্যেও তোমার স্থান । তুমি আমার প্রেমিক, আমি তোমার প্রেমিক । আমার ইচ্ছায় আমি তোমার ইচ্ছাকে স্থান দেব, আমার আনন্দে আমি তোমার আনন্দকে গ্ৰহণ করব- এইজন্যেই আমার এত দুঃখ, এত বেদনা, এত আয়োজন । এ দুঃখ তোমার জগতে আর-কারও নেই। নিজের অন্তর-বাহিরের সঙ্গে দিনরাত্রি লড়াই করতে করতে এ কথা আর-কেউ বলছে না ‘আবিরাবীর্ম এধি’ | তোমার বিচ্ছেদবেদনা বহন করে জগতে আর-কেউ এমন করে কাদছে না যে “মা মা হিংসীঃ’ । তোমার পশুপক্ষীরা বলছে ; আমার ক্ষুধা দূর করো, আমার শীত দূর করো, আমার তাপ দূর করো। আমরাই বলছি: বিশ্বানি দেব সবিতরন্দুরিতানি পরাসুব। আমার সমস্ত পাপ দূর করো। কেন বলছি। নইলে, হে প্ৰকাশ, আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ হয় না । সেই মিলন না হওয়ার যে দুঃখ সে দুঃখ কেবল আমার নয়, সে দুঃখ অনন্তের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে আছে । এইজন্যে, মানুষ যে দিকেই ঘুরুক, যাই করুক, তার সকল চেষ্টার মধ্যেই সে চিরদিন এই সাধনার মন্ত্রটি বহন করে নিয়ে চলেছে : আবিরাবীর্ম এধি । এ তার কিছুতেই ভোলবার নয়। আরাম-ঐশ্বর্যের পুস্পশয্যার মধ্যে শুয়েও সে ভুলতে পারে না । দুঃখযন্ত্রণার অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে পড়েও সে ভুলতে পারে না। প্রকাশ, তুমি আমার মধ্যে প্রকাশিত হও, তুমি আমার হও,