পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন μ \bSS আমাদের আশ্রমের শালতারুর শ্রেণী এবং তালবনের শিখরের উপর একটা কোলাহল জেগে উঠল, তার পরে দেখতে দেখতে আমবাগানের সমস্ত ডালে ডালে আন্দোলন পড়ে গেল, পাতায় পাতায় মাতামতির কলমর্মরে আকাশ ভরে গেল- ঘনধারায় বৃষ্টি নেমে এল । তার পর থেকে এই চকিত বিদ্যুতের সঙ্গে থেকে থেকে মেঘের গর্জন, বাতাসের বেগ এবং অবিরল বর্ষণ চলেছে । মেঘাচ্ছন্ন সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমে নিবিড় হয়ে এসেছে । আজ যে-সব কথা বলবার প্রয়োজন আছে মনে করে এসেছিলুম সে-সব কথা কোথায় যে চলে গিয়েছে তার ঠিকানা নেই। দীর্ঘকাল অনাবৃষ্টির খরতাপে চারি দিকের মাঠ শুষ্ক হয়ে দগ্ধ হয়ে গিয়েছিল, জল আমাদের ইদারার তলায় এসে ঠেকেছিল, আশ্রমের ধেনুদল ব্যাকুল হয়ে উঠছিল। স্নান ও পানের জলের কিরকম ব্যবস্থা করা হবে সেজন্যে আমরা নানা ভাবনা ভাবছিলুম ; মনে হচ্ছিল যেন এই কঠোর শুষ্কতার দিনের আর কোনোমতেই অবসান হবে না । এমন সময় এক সন্ধ্যার মধ্যেই নীল স্নিগ্ধ মেঘ আকাশ ছেয়ে ছড়িয়ে পড়ল ; দেখতে দেখতে জলে একেবারে চারি দিক ভেসে গেল ! ক্রমে ক্রমে নয়, ক্ষণে ক্ষণে নয়, চিন্তা করে নয়, চেষ্টা করে নয়— পূর্ণতার আবির্ভাব একেবারে অবারিত দ্বার দিয়ে প্রবেশ করে অনায়াসে সমস্ত অধিকার করে নিলে । গ্ৰীষ্ম সন্ধ্যার এই অপৰ্যাপ্ত বর্ষণ, এই নিবিড় সুন্দর স্নিগ্ধতা, আমারও মন থেকে সমস্ত প্ৰয়াস সমস্ত ভাবনাকে একেবারে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। পরিপূর্ণতা যে আমারই ক্ষুদ্র চেষ্টার উপর নির্ভর করে দীনভাবে বসে নেই, আমার সমস্ত অন্তঃকরণ যেন এই কথাটা এক মুহুর্তে অনুভব করলে। পরিপূর্ণতাকে শনৈঃ শনৈঃ করে, একটুর সঙ্গে আর-একটুকে জুড়ে গীেথে, কোনো কালে পাবার জো নেই। সে মৌচাকের মধু ভরা নয়, সে বসন্তের এক নিশ্বাসে বনে ঘনে লক্ষকোটি ফুলের নিগুঢ় মর্মকোষে মধু সঞ্চারিত করে দেওয়া । অত্যন্ত শুষ্কতা অত্যন্ত অভাবের মাঝখানেও পূর্ণস্বরূপের শক্তি আমাদের অগোচরে আপনিই কাজ করছে- যখন তার সময় হয় তখন নৈরাশ্যের অপার মরুভূমিকেও সরসতায় অভিষিক্ত করে অকস্মাৎ সে কী আশ্চৰ্যরূপে দেখা দেয় ; বহুদিনের মৃতপত্র তখন এক মুহূর্তে বেঁটিয়ে ফেলে, বহুকালের শুষ্ক৷ ধূলিকে এক মুহুর্তে শ্যামল করে তোলে- তার আয়োজন যে কোথায় কেমন করে হচ্ছিল তা আমাদের দেখতেও দেয় না । এই পরিপূর্ণতার প্রকাশ যে কেমন- সে যে কী বাধাহীন, কী প্রচুর, কী মধুর, কী গভীর— সে আজ এই বৈশাখের দিব্যাবসানে সহসা দেখতে পেয়ে আমাদের সমস্ত মন আনন্দে গান গেয়ে উঠেছে । আজ অস্তরে বাহিরে এই পরিপূর্ণতারই সে অভ্যর্থনা করছে। সেইজন্যে, আজ তোমাদের যে কিছু উপদেশের কথা বলব আমার সে মন নেই, কিছু বলবার যে দরকার আছে সেও আমার মন বলছে না ; কেবল ইচ্ছা করছে বিশ্বজগতের মধ্যে যে-একটি পরমগভীর অন্তহীন আশা জেগে রয়েছে, কোনো দুঃখ-বিপত্তি-অভাবে যাকে পরাস্ত করতে পারছে না, গানের সুরে তার কাছে আমাদের আনন্দ আজ নিবেদন করে দিই। বলি, “আমাদের ভয় নেই, আমাদের ভয় নেই- তোমার পরিপূর্ণ পাত্র নিয়ে যখন দেখা দেবে সে পত্র উচ্ছসিত হয়ে পড়তে থাকবে, যে দীনতা কোনােদিন পূরণ হতে পারে এমন কেউ মনে করতেও পারে না সেও পূরণ হয়ে যাবে ; নামবে তোমার বর্ষণ, একেবারে ঝর ঝর করে ঝরতে থাকবে তোমার প্রসাদধারা ; গহবর যত গভীর তা ভরবে তেমনি গভীর করে ।” আজ আর কিছু নয়, আজ মনকে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ করে পেতে দিই তার কাছে। আজ অস্তরের অন্তরতম গভীরতার মধ্যে অনুভব করি সেখানটি ধীরে ধীরে ভরে উঠছে। বারিধারা ঝরছে ঝরছে- সমস্ত ধুয়ে যাচ্ছে, স্নিগ্ধ হয়ে যাচ্ছে ; সমস্ত নবীন হয়ে উঠছে, শ্যামল হয়ে উঠছে । বাইরে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, বাইরে সমস্ত মেঘাবৃত, সমস্ত নিবিড় অন্ধকার, তারই মধ্যে নেমে আসছে তার নিঃশব্দচরণ দূতগুলি, ভরে ভরে নিয়ে আসছে তারই সুধাপাত্ৰ । আজ যদি এই মন্দিরের মধ্যে বসে সমস্ত মনটিকে প্রসারিত করে দিই, এই জনশূন্য মাঠের মাঝখানে, এই অন্ধকারে-ঘেরা আশ্রমের তরুশাখাগুলির মধ্যে, তবে প্রত্যেক ধূলিকণাটির মধ্যে কী গৃঢ় গভীর পুলক অনুভব করব ! সেই পুলকোচ্ছাসের গন্ধে আকাশ ভরে গিয়েছে ; প্রত্যেক তৃণ প্রত্যেক পাতাটি আজ উৎফুল্প হয়ে উঠেছে—তাদের সংখ্যা গণনা করতে কে পারে !! পৃথিবীর এই একটি পরিব্যাপ্ত আনন্দ নিবিড়