পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Va: রবীন্দ্র-রচনাবলী মেঘাচ্ছন্ন সন্ধ্যাকাশের মধ্যে আজ নিঃশব্দে রাশীিকৃত হয়ে উঠেছে। চারি দিকের এই মুক অব্যক্ত প্ৰাণের খুশির সঙ্গে মানুষ তুমিও খুশি হও! এই সহসা অভাবনীয়কে বুক ভরে পাবার যে খুশি, এই এক মুহুর্তে সমস্ত অভাবের দীনতাকে একেবারে ভাসিয়ে দেবার যে খুশি, সেই খুশির সঙ্গে মানুষ তোমার সমস্ত মন প্ৰাণ শরীর আজ খুশি হয়ে উঠুক। আজকের এই গগনাব্যাপী ঘোর ঘনঘটাকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করি । বহুদিনের কর্মক্ষোভ হতে উখিত ধূলির আবরণ ধুয়ে আজ ভেসে যাক-পবিত্র হই, স্নিগ্ধ হই। এসো এসো, তুমি এসো- আমার দিকদিগন্ত পূৰ্ণ করে তুমি এসো ! হে গোপন, তুমি এসো ! প্রান্তরের এই নির্জন অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আকাশের এই নিবিড় বৃষ্টিধারার মধ্য দিয়ে তুমি এসো ! সমস্ত গাছের পাতা সমস্ত তৃণদলের সঙ্গে আজ পুলকিত হয়ে উঠি । হে নীরব, তুমি এসো, আজ বিনা সাধনের ধন হয়ে ধরা দাও— তোমার নিঃশব্দ চরণের স্পৰ্শলাভের জন্য আজ আমার সমস্ত হৃদয়কে তোমার সমস্ত আকাশের মধ্যে মেলে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসি । ৬. বৈশাখ ১৩১৮ EG లిybr সত্যবোধ আজকের এই প্ৰান্তরের উপর জ্যোৎস্নার আলোক দেখে আমার অনেক দিনের আরো কয়েকটি জ্যোৎস্নারাত্রির কথা মনে পড়ছে । তখন আমি পদ্মানদীতে বাস করতুম | পদ্মার চরে নীেকা বাধা থাকত । শুক্লপক্ষের রাত্ৰিতে কতদিন আমি একলা সেই চরে বেড়িয়েছি। কোথাও ঘাস নেই, গাছ নেই, চাঁদের আলোর সঙ্গে বালুচরের প্রান্ত মিশিয়ে গেছে- সেই পরিব্যাপ্ত শুভ্রতার মধ্যে একটিমাত্র যে ছায়া সে কেবল আমার । সেই আমার নির্জন সন্ধ্যায় আমার একজন সঙ্গী জুটল । তিনি আমাদের একজন কর্মচারী । তিনি আমার পাশে চলতে চলতে অনেক সময়েই দিনের কাজের আলোচনায় প্রবৃত্ত হতেন । সে সমস্তই দেনাপাওনার কথা, জমিদারির কথা, আমাদের প্রয়োজনের কথা । সেই আমার কানের কাছে সেই একটিমাত্র মানুষের একটুখানি কণ্ঠের ধ্বনি এতবড়ো নক্ষত্ৰলোকের অখণ্ড নিস্তব্ধতাকে এক মুহুর্তে ভেঙে দিত এবং এতবড়ো একটি নিভৃত শুভ্রতার উপরেও যেন ঘোমটা পড়ে যেত, তাকে আর যেন আমি স্পষ্ট করে দেখতেই পেতুম না। তার পরে তিনি চলে গেলে হঠাৎ দেখতে পেতুম আমি এতক্ষণ অত্যন্ত ছােটাে হয়ে গিয়েছিলুম, সেইজন্যে চার দিকের বড়োকে আমি আর সত্য বলে জানতে পারছিলুম না ; এতবড়ো শান্তিময় সৌন্দর্যময় আকাশ-ভরা প্রত্যক্ষ বর্তমােনও আমার কাছে একেবারে কিছুই না হয়ে গিয়েছিল । এই নিয়ে কতদিন মনের মধ্যে আমি বিস্ময় অনুভব করেছি। এই কথা মনে ভেবেছি, যতক্ষণ কেবল আমারই সংক্রান্ত কথা হচ্ছিল, আমারই বিষয়কর্ম, আমারই আয়োজন প্রয়োজন— আমার মনের মধ্যে আমিই যখন একমাত্র প্রধান ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলুম- বস্তুত তখনই আমার বিশ্বের মধ্যে আমিই সকলের চেয়ে ছোটাে হয়ে গিয়েছিলুম। ততক্ষণ চাদ আমার কাছ থেকে তার জ্যোৎস্না ফিরিয়ে নিয়েছিল, নদীর কলধ্বনি আমাকে একেবারে নগণ্য করে দিয়ে পাশে থেকেও আমাকে অস্পৃশ্যের মতো পরিহাস করে চলে গিয়েছিল, এই দিগন্তব্যাপী শুভ্ৰ আকাশের মধ্যে তখন আমি আর ছিলুম না- আমি নির্বাসিত হয়ে গিয়েছিলুম। শুধু তাই নয়, তখন আমার মনের মধ্যে যে ভাব, যে ভাবনা, চারি দিকের বিশ্বজগতের সঙ্গে তার যেন কোনাে সত্য যোগ নেই। নিখিলের মাঝখানে তাকে ধরে দেখলে দেখতে পাওয়া যায় সে একটা অদ্ভুত মিথ্যা । জমিজমা হিসাব-কিতাব মামলা-মকদ্দমা। এ-সমস্ত শূন্যগর্ভ বুদবুদ বিশ্বাসাগরের মধ্যে কোনো চিহ্নমাত্র না রেখে মুহুর্তে মুহুর্তে কত শতসহস্ৰ বিদীর্ণ হয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ।