পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

W288 রবীন্দ্র-রচনাবলী বলবার অধিকার দাও । সমস্ত সংসারের দীর্ঘ পথ দুঃখের বোঝা বয়ে এসেছি, আজ দিলুম তোমার পায়ে ফেলে। তুমি যে আনন্দ, তুমি যে অমৃত, এই কথাটি আজ স্মরণ করব । সেই স্মরণ করবার দিনই এই মহােৎসবের দিন । আসতো মা সদগময়। অসত্যে জড়িয়ে আছি, তোমার সঙ্গে মিললে তবে সত্য হব। তোমার সঙ্গে সত্যে মিলন হবে, জ্ঞানের জ্যোতিতে মিলন হবে । মৃত্যুর পথ মাড়িয়ে অমৃতলোকে মিলন হবে । বিশ্বজগৎকে তোমার প্রকাশ যেমন প্ৰকাশিত করছে তেমনি আমার জীবনকে করবে । ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ হরিঃ ওঁ । 2V3<=er , YY NIR Yvoso ফাল্গুন ১৩২০ ছোটো ও বড়ো । এগারোই মাঘ সায়ংকালে লেখক-কর্তৃক পঠিত উপদেশ এই সংসারের মাঝখানে থেকে সংসারের সমস্ত তাৎপৰ্য খুঁজে পাই আর নাই পাই, প্রতিদিনের তুচ্ছতার মধ্যে মানুষ ক্ষণকালের খেলা যেমন করেই খেলুক, মানুষ আপনাকে সৃষ্টির মাঝখানে একটা খাপছাড়া ব্যাপার বলে মনে করতে পারে না । মানুষের বুদ্ধি ভালোবাসা আশা আকাঙক্ষা সমস্তের মধ্যেই মানুষের উপস্থিত প্রয়োজনের অতিরিক্ত এমন একটা প্ৰভূত বেগ আছে যে মানুষ নিজের জীবনের হিসাব করবার সময়, যা তার হাতে আছে তার চেয়ে অনেক বেশি জমা করে নেয়। মানুষ আপনার প্রতিদিনের হাত-খরচের খুচরো তহবিলকেই নিজের মূলধন বলে গণ্য করে না । মানুষের সকল কিছুতেই যে-একটি চিরজীবনের উদ্যম প্ৰকাশ পায় সে যে একটা অদ্ভুত বিড়ম্বনা, মরীচিকার মতো সে যে কেবল জলকে দেখায় অথচ তৃষ্ণাকে বহন করে, এ কথা সমস্ত মনের সঙ্গে সে বিশ্বাস করতে পারে না। ভোগী ভোগের মধুপাত্রের মধ্যে আপনার দুই ডানা জড়িয়ে ফেলে বসে আছে, বুদ্ধি-অভিমানী জোনাক-পোকার মতো আপন পুচ্ছের আলোক-সীমার বাইরে আর সমস্তকেই অস্বীকার করছে, অলসচিত্তে উদাসীন তার নিমীলিত চক্ষুপল্লবের দ্বারা আপনার মধ্যে একটি চিররাত্রি রচনা করে পড়ে আছে, তবু সমস্ত মত্ততা অহংকার এবং জড়ত্বের ভিতর দিয়ে মানুষ নানা দেশে নানা ভাষায় নানা আকারে প্রকাশ করবার চেষ্টা করছে যে “আমার সত্য প্রতিষ্ঠা আছে এবং সে প্রতিষ্ঠা এইটুকুর মধ্যে নয় । সেইজন্যে আমরা যাকে দেখলুম না, যাকে প্রত্যক্ষ প্রমাণ করলুম না, র্যাকে সংসারবুদ্ধিটুকুর বেড়া দিয়ে ঘের দিয়ে রাখলুম না, তার দিকে মুখ তুলে ধারা বললেন “তদেতৎ প্ৰেয়ঃ পুত্রাৎ প্রেয়ো বিত্তাৎ প্রেয়োহন্যস্মাৎ সর্বস্মাৎ- এই তিনি পুত্র হতে প্রিয়, বিত্ত হতেও প্রিয়, অন্য সব কিছু হতেও প্ৰিয়তাদের সেই বাণীকে আমাদের জীবনের ব্যবহারে সম্পূর্ণ গ্ৰহণ করতে না পেরেও আজ পর্যন্ত অগ্রাহ্য করতে পারলুম না। এইজন্যে যখন আমরা তার ভক্তকে দেখলুম। তিনি কোন অন্তহীনের প্রেমে জীবনের প্রতি মুহুর্তকে মধুময় করে বিকশিত করছেন, যখন তার সেবককে দেখলুম। তিনি বিশ্বের কল্যাণে প্রাণকে তুচ্ছ এবং দুঃখ-অপমানকে গলার হার করে তুলছেন, তখন তাদের প্রণাম করে আমরা বললুম। এইবার মানুষকে দেখা গেল । সমস্ত বৈষয়িকতা সমস্ত দ্বেষবিদ্বেষ ভাগবিভাগের মাঝখানে এইটি ঘটছে ; কিছুতেই এটিকে আর চাপ দিতে পারলে না । মানুষের মধ্যে এই-যে অনন্তের বিশ্বাস, এই-যে অমৃতের আশ্বাসটি বীজের মতো রয়েছে, বারংবার দলিত বিদলিত হয়েও সে মরাল না । এ যদি শুধু তর্কের সামগ্ৰী হত। তবে তর্কের আঘাতে আঘাতে চূৰ্ণ হয়ে যেত ; কিন্তু এ যে মর্মের জিনিস, মানুষের সমস্ত প্রাণের কেন্দ্ৰস্থল থেকে এ যে অনির্বচনীয়রূপে আপনাকে প্রকাশ করে ।