পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন \ე(!\!-2) তিনি জানেন যে বধির সেও শুনবে, চিরযুগের রুদ্ধদ্বার একদিন খুলবে, পাষাণ একদিন গলবে । এই বাধা-বিরোধের ভিতর থেকে তিনি টেনে নেবেন । মানুষের জাগরণ সহজ নয় বলেই তার মূল্য যে বেশি। এই জাগরণের জন্য যুগ যুগ যে অপেক্ষা করতে হয় । যেদিন জাগবে মানুষ সেদিন পাখির গানের চেয়ে তার গানের মূল্য অনেক বেশি হবে, ফুলের সৌন্দর্যের চেয়ে তার সৌন্দৰ্য অনেক বেশি হবে । মানুষ আজ বিদ্রোহ করছে ; কিন্তু ঝড়ের মেঘ যেমন শ্রাবণের ধারায় বিগলিত হয়ে তার বাজবিদ্যুৎকে নিঃশেষ করে মাটিতে লুটিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়, তেমনি বিদ্রোহী মানুষ যেদিন ঝোড়ো মেঘের মতো কেঁদে ঝরে পড়বে সেদিন মরুভূমিতে বিকশিত হবে ফুলতার মূল্য যে অনেক বেশি। সেইজন্য যুগ যুগ রাত্রিদিন তিনি জেগে রইলেন, অপেক্ষা করে রইলেন, পাপীর পাপের মলিনতা ধৌত হয়ে কবে তার হৃদয় ফুলের মতো নির্মল হয়ে ফুটে উঠবে । বৎসরে বৎসরে উৎসব ব্যর্থ হয় ; দিনের পর দিন আলোকদূত ফিরে ফিরে যায় ; অন্ধকার নিশীথিনীর তারকার রাত্রির পর রাত্রি একই আহবানের পুনরাবৃত্তি করতে থাকে, ক্ষান্ত হয় না। ক্লাস্তি আসে না- কারণ, এই আশা যে জেগে রয়েছে যে যেদিন মানুষ। ডাক শুনবে সেদিন সমস্ত সার্থক হবে । আজ উৎসবের প্রাঙ্গণে আমরা এসেছি ; এ দিন সকলের উৎসবের দিন কি না তা জানি না । সম্বৎসর তিনি ফুল ফুটিয়েছেন, প্রতিদিনই আমাদের ডেকেছেন। আজ কি আমরা নিজের হাতের তৈরি এই উৎসবক্ষেত্রে তার সেই প্ৰতি নিমেষের সাড়া দিচ্ছি। হে উৎসবের দেবতা, তোমার উৎসবের ক্ষেত্র ব্যর্থ হবে না । তুমি সাজিয়েছ, আমরা এসেছি। আমরা বললুম ‘পিতা নোহসি ; তুমি পিতা এই কথা স্বীকার করলুম। বললুম নমস্তেহস্তু, নমস্কার সত্য হােক | নমস্কার তো সত্য হয় নি। সংসারের মধ্যে নমস্কার সত্য হয় নি । তোমাকে বঞ্চনা করেছি। ক্ষমতার পায়ে, ধনের পায়ে নমস্কার করেছি। হে আমার উৎসব দেবতা, আজ একটুখানি নমস্কার বঁচিয়ে এনেছি- আজি আসবার সময় ধনমানের কাছ থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে একটু নমস্কার আনতে পেরেছি- সে না হতে পারে প্রতিদিনের নমস্কার, না হতে পারে সমস্ত জীবনের নমস্কার, কিন্তু এই ক্ষণকালের নমস্কার তুমি নাও, সমস্ত জীবনের অসাড়তা অচৈতন্য দূর হােক, তুমি নিজের হাতে で所I引Sー তুমি আপনি জাগাঁও মোরে তব সুধাপরশে । 2N53 SS Ne SWSS ফায়ুন ১৩২১ ৷ অমৃতের পুত্ৰ অমৃত-উৎসের ধারে মানুষকে একবার করে আসতে হবে এবং আপনাকে নতুন করে নিতে হবে । জীবনের তত্ত্বই হচ্ছে মরণের ভিতর দিয়ে নতুনকে কেবলই প্ৰকাশ করা । সংসারের মধ্যে জরা সব জীৰ্ণ করছে, যা-কিছু নতুন তার উপর সে তার তপ্ত হাতের কালিমা বোলাচ্ছে, তাই দেখতে দেখতে নির্মল ললাটে বলির রেখা পড়ে- সকল কর্মের ক্লান্তি ও অবসাদ কেবলই জমে ওঠে । এই জরার আক্রমণে আমরা প্ৰতিদিন পুরাতন হয়ে যাচ্ছি। সেইজন্য মানুষ নানা উপলক্ষ করে একটি জিনিসকে কেবলই প্রকাশ করতে চায়। সে জিনিসটি তার চিরযৌবন । জর দৈত্য যে তার সব রক্ত শোষণ করেছে সে এ কথা মানতে চায় না । সে জানে যে তার অন্তরের চিরনবীন চিরযৌবনের ভাণ্ডারে অমৃত পরিপূর্ণ। সেই কথাটি ঘোষণা করবার জন্যই মানুষের উৎসব । মানুষ দেখতে পেয়েছে যে সংসারের সঞ্চয় প্রতিদিন ক্ষয় হয়ে যায়। যতই ভয় ভাবনা করি, যতই আগলে আগলে রাখি, কাল সমস্তই নষ্ট করবে- নবীন সৌন্দর্য কোথাও রাখবে না। সংসার যে বৃদ্ধকে তৈরি করছে ; সে আরম্ভ করে নবীন শিশুকে নিয়ে, তার পরে একদিন বৃদ্ধ করে তাকে ছেড়ে দেয় । প্ৰভাতের শুভ্ৰ নিৰ্মলতা নিয়ে সে আরম্ভ করে, তার পরে তার উপর কালের প্রলেপ দিতে দিতে তাকে নিশীথ রাত্রের কালিমায় হারিয়ে ফেলে ।