পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আজকের ৭ই পৌষের উৎসবের সঙ্গে সেই উপদেশের যোগ আছে। fòs Revelation-13 চতুর্থ অধ্যায় থেকে এই শ্লোকটি তার উপদেশের বিষয় করে নিয়েছেনAfter this I looked, and, behold, a door was opened in heaven ; and the first voice I heard was as it were a trumpet talking with me; which said: Come up hither and I will show thee things that shall be hereafter. তার উপদেশের ভিতরকার কথা হচ্ছে এই : বরাবর এই কথা আছে ‘তুমি এসো আরো কিছু দেখাবার আছে ; এই বাণী বরাবর মানুষ শুনে আসছে। আমাদের কোনো জায়গায় ঈশ্বর বদ্ধ থাকতে দেবেন না । জ্ঞানে ভাবে কর্মে সমাজে সকল দিকে স্বৰ্গ থেকে, উপর থেকে, ডাক আসছে ; তোমরা চলে এসো, তোমরা বসে থাকতে পারবে না । ইহলোকের মধ্যেই সেই hereafter, সেই পরে যা হবে, তার ডাক মানুষ শুনেছে বলেই তার সমাজে উন্নতি হচ্ছে, তার জ্ঞান প্রসার লাভ করছে । পশু এ ডাক শোনে না- তাকে কেউ বলে না যে, তুমি যা দেখছ যা পােচ্ছ তাই শুধু নয়— আরো অনেক বাকি আছে। মানুষেরই এই একটি বিশেষ গৌরবের জিনিস যে, মানুষকে ঈশ্বর স্থির নিশ্চল হয়ে বসে থাকতে দিলেন না । যেখানে তার বদ্ধতা, তার সংকীর্ণতা, সেখানে ক্ৰমাগতই আহবান আসছে ; আরো কিছু আছে, আরো আছে। যা হয়েছে তা হয়েছে। এ বলে যদি দাড়াই, যদি সেই “আরো আছের ডাককে অমান্য করি, তা হলে মানুষের ধর্মের পতন । যদি তাকে জ্ঞানে অমান্য করি তা হলে মানুষের মুঢ়তায় পতন । যদি সমাজে অমান্য করি তা হলে জড়তায় পতন । কালে কালে মহাপুরুষেরা কী দেখান । তঁরা দেখান যে, তোমরা যাকে ধর্ম বলে ধরে রয়েছ ধর্ম তার মধ্যে পর্যাপ্ত নন। মানুষকে মহাপুরুষেরা মুক্তির পথ দেখিয়ে দেন ; তঁরা বলেন : চলতে হবে । কিন্তু, মানুষ তাদেরই আশ্রয় করে খুঁটি ধরে দাড়িয়ে যায়, আর চলতে চায় না । মহাপুরুষেরা যে পর্যন্ত গিয়েছেন তারও বেশি তাদের অনুপহীরা যাবেন, এই তো তাদের ইচ্ছা। কিন্তু, তারা তাদের বাক্য গলায় বেঁধে আত্মহত্যা সাধন করে। মহাপুরুষদের পথ হচ্ছে পথ, কেবলমাত্র পথ। তঁরা সেই পথে চলেছিলেন এইটেই সত্য । সুতরাং পথে বসলে গম্যস্থানকে পাব না, পথে চললেই পাব। উপরের থেকে সেই চলবার ডাকটিই আসছে। সেই বাণীই বলছে : তুমি বসে থেকে কিছু পাবে না ; চলো, আরো চলো ; আরো আছে, আরো আছে। মানুষের ধর্ম চলছে তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। ধর্ম আমাদের কোনো সীমাবদ্ধ জিনিসের পরিচয় দিচ্ছে না, ধর্ম অসীমের পরিচয় দিচ্ছে। পাখি। যেমন আকাশে ওড়ে এবং উড়তে উড়তে আকাশের শেষ পায় না, তেমনি আমরা অনন্তের মধ্যে যে অবাধ গতি রয়েছে তাতেই চলতে থাকব। পাখি পিঞ্জরের মধ্যে ছট্‌ফট্ৰ করে তার কারণ এ নয় যে, সে তার প্রয়োজন সেখানে পাচ্ছে না, কিন্তু তার প্রয়োজনের চেয়ে বেশিকেই পাচ্ছে না । মানুষেরও। তাই চাই। প্রয়োজনের চেয়ে বেশিতেই মানুষের আনন্দ । মানুষের ধর্ম হচ্ছে অনন্তে বিহার, অনন্তের আনন্দকে পাওয়া । মানুষ যেখানে ধর্মকে বিশেষ দেশকালে আবদ্ধ করেছে সেখানে যে ধর্ম তাকে মুক্তি দেবে সেই ধৰ্মই তার বন্ধন হয়েছে। য়ুরোপে ধর্ম যেখানে তাকে বেঁধেছে। সেইখানেই মুক্তির uPU 6o di ICR onward cry NiCSI cry আজকে র্যার দীক্ষার সাম্বাৎসরিকে আমরা এসেছি। তিনি onward cry শুনতে পেয়েছিলেন । যে সময়ে আমাদের দেশে ধর্মকে সমাজকে চারি দিক থেকে নানা আচার ও প্রথার বন্ধনে বেঁধেছিল, তাকে সংকীর্ণ করে রুদ্ধ করে রেখেছিল, সেই সময়ে তিনি এই আহবান শুনে জেগে উঠলেন । চারি দিকের এই রুদ্ধতা, এই বেড়াগুলো, তাকে অত্যন্ত বেদনা দিয়েছিল । তিনি যখন আকাশে উড়তে চেয়েছিলেন তখন পিঞ্জরের | প্ৰত্যেকটি শলাকা তাকে আঘাত করেছিল । তিনি জীবনকে প্রতিদিন অগ্রসর করবেন, প্ৰতিদিন অনন্তের আস্বাদ আপনার ভিতর থেকে পাবেন, তীর এই আকাঙ্ক্ষা সেদিনকার সমাজে বড়োই দুর্লভ ছিল । সকলেই নিজ নিজ প্রচলিত অভ্যাসে তৃপ্ত ছিল। এই ৭ই পীেষের দিন তিনি তার দীক্ষার আহবান শুনেছিলেন, সে আহবান এই মন্ত্রটি : ঈশাবাস্যমিদং সৰ্বং । দেখো, তার মধ্যে সব দেখো । এই আহবান, এই দীক্ষামন্ত্ৰই তো এই আশ্রমের মধ্যে রয়েছে। উপনিষদের এই মন্ত্র, এ কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের নয়, এ কোনো বিশেষ সম্প্রদায়কে সৃষ্টি করে না। এ বাণী দেশে দেশান্তরে নিবািরধারার মতো যুগে যুগে প্রবাহিত হয়ে চলতে থাকবে : দেখো, তার মধ্যে সব দেখো ।