পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন ዪኃዓዓ আমরা আজ এই পাপের মূর্তি যে কী প্ৰকাণ্ড তা কি দেখব না। এই পাপ যে সমস্ত মানুষের মধ্যে রয়েছে এবং আজ তাই এক জায়গায় পুঞ্জীভূত হয়ে বিরাট আকার নিয়ে দেখা দিয়েছে, এ কথা কি আমরা বুঝব না। আমরা এ দেশে প্রতিদিন পরস্পরকে আঘাত করছি, মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি, স্বার্থকে একান্ত করে তুলছি। এ পাপ কতদিন ধরে জমছে, কত যুগ ধরে জমছে। প্রতিদিনই কি আমরা তারই মার খাচ্ছি নে । বহু শতাব্দী থেকে আমরা কি কেবলই মরছি নে । সেইজন্যই তো এই প্রার্থনা ; মা মা হিংসীঃ । বঁাচাও বাচাও, এই বিনাশের হাত থেকে বাচাও । এই সমস্ত দুঃখশোকের উপরে যে অশোক লোক রয়েছে, অনন্ত-অন্তের সম্মিলনে যে অমৃতলোক সৃষ্ট হয়েছে, সেইখানে নিয়ে যাও । সেইখানে মরণের উপরে জয়ী হয়ে আমরা বাচব ; ত্যাগের দ্বারা, দুঃখের দ্বারা বঁচিব । সেইখানে আমাদের মুক্তি দাও । আজ অপ্ৰেমঝঙ্কার মধ্যে, রক্তস্রোতের মধ্যে, এই বাণী সমস্ত মানুষের ক্ৰন্দনধ্বনির মধ্যে জেগে উঠেছে । এই বাণী হাহাকার করতে করতে আকাশকে বিদীর্ণ করে বয়ে চলেছে । সমস্ত মানবজাতিকে বঁাচাও । আমাকে বঁাচাও । এই বাণী যুদ্ধের গর্জনের মধ্যে মুখরিত হয়ে আকাশকে বিদীর্ণ করে দিয়েছে। স্বার্থের বন্ধনে জর্জর হয়ে, রিপুর আঘাতে আহত হয়ে, এই—যে আমরা প্ৰত্যেকে পাশের লোককে আঘাত করছি ও আঘাত পাচ্ছি- সেই প্রত্যেক আমির ক্ৰন্দনধ্বনি একটা ভয়ানক বিশ্বযজ্ঞের মধ্যে সকল মানুষের প্রার্থনারীপে রক্তস্রোতে গৰ্জিত হয়ে উঠেছে ; মা মা হিংসীঃ । মরছে মানুষ, বাচাও তাকে । কে বাচাবে । পিতা নোহসি । তুমি যে আমাদের সকলের পিতা, তুমি বঁাচাও । তোমার বোধের দ্বারা বঁাচাও । তোমাকে সকল মানুষ মিলে যেদিন নমস্কার করব সেই দিন নমস্কার সত্য হবে । নইলে ভুলুষ্ঠিত হয়ে মৃত্যুর মধ্যে যে নমস্কার করতে হয় সেই মৃত্যু থেকে বীচাও । দেশদেশান্তরে তোমার যত যত সন্তান আছে, হে পিতা, তুমি প্ৰেমে ভক্তিতে কল্যাণে সকলকে একত্র করে তোমার চরণতলে । নমস্কার সর্বত্র ব্যাপ্ত হোক । দেশ থেকে দেশান্তরে জাতি থেকে জাতিতে ব্যাপ্ত হােক । বিশ্বানি দুরিতানি পরাসুব। বিশ্বপাপের যে মূর্তি আজ রক্তবর্ণে দেখা দিয়েছে সেই বিশ্বপাপকে দূর করো। মা মা হিংসীঃ । বিনাশ থেকে রক্ষা করো। ২০ শ্রাবণ ১৩২১ আশ্বিন-কার্তিক ১৩২১ পাপের মার্জনা আমাদের প্রার্থনা সকল সময়ে সত্য হয় না, অনেক সময়ে মুখের কথা হয় ; কারণ, চারি দিকে অসত্যের দ্বারা পরিবৃত হয়ে থাকি বলে আমাদের বাণীতে সত্যের তেজ পৌঁছয় না। কিন্তু, ইতিহাসের মধ্যে, জীবনের মধ্যে, এমন এক-একটি দিন আসে যখন সমস্ত মিথ্যা এক মুহুর্তে দগ্ধ হয়ে গিয়ে এমনি একটি আলোক জেগে ওঠে যার সামনে সত্যকে অস্বীকার করবার উপায় থাকে না । তখনই এই কথাটি বার বার জাগ্রত হয় ; বিশ্বানি দেব সবিতরন্দূরিতানি পরাসুব | হে দেব, হে পিতা, বিশ্বপাপ মার্জনা করো। আমরা তার কাছে এ প্রার্থনা করতে পারি না। "আমাদের পাপ ক্ষমা করো ; কারণ, তিনি ক্ষমা করেন না, তিনি সহ্য করেন না। র্তার কাছে এই প্রার্থনাই সত্য প্রার্থনা ; তুমি মার্জনা করো। যেখানে যতী-কিছু পাপ আছে, অকল্যাণ আছে, বারংবার রক্তস্রোতের দ্বারা, অগ্নিবৃষ্টির দ্বারা, সেখানে তিনি মার্জনা করেন। যে প্রার্থনা ক্ষমা চায় সে দুর্বলের ভীরুর প্রার্থনা, সে প্রার্থনা তার দ্বারে গিয়ে পৌছবে না। আজ এই-যে যুদ্ধের আগুন জ্বলেছে। এর ভিতরে সমস্ত মানুষের প্রার্থনাই কেঁদে উঠেছে ; বিশ্বানি দুরিতানি পরাসুব। বিশ্বপাপ মার্জনা করে । আজ যে রক্তস্রোত প্রবাহিত হয়েছে সে যেন ব্যর্থনা হয়। রক্তের বন্যায় যেন পুঞ্জীভূত পাপ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। যখনই পৃথিবীর পাপ তুপাকার হয়ে উঠে তখনই তো তার মার্জনার দিন আসে। আজ সমস্ত পৃথিবী জুড়ে যে দহনযজ্ঞ হচ্ছে তার রুদ্র আলোকে এই প্রার্থনা সত্য হােক : বিশ্বানি দুরিতানি পরাসুব। আমাদের প্রত্যেকের জীবনের মধ্যে আজ এই প্রার্থনা সত্য হয়ে উঠুক। আমরা প্রতিদিন সংবাদপত্রে টেলিগ্রাফে যে একটু-আধটু খবর পাই তার পশ্চাতে কী অসহ্য সব দুঃখ রয়েছে আমরা কি তা চিন্তা করে দেখি । যে হানাহানি হচ্ছে তার সমস্ত বেদনা কোনখানে গিয়ে লাগছে।