পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন Vybr6 সেখানে যে পিতা নেই। সে বড়ো দৈন্য, সে পরম দারিদ্র্য । যিনি রয়েছেন সর্বত্রই তাকে আমি পাই না । পাই না, কারণ ভক্তি নেই। যুক্তি খুঁজে পাওয়া সহজ, কিন্তু ভক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। আনন্দ সহজ না হলে পাওয়া যায় না । উপনিষদে বলে- মন বাক্য তাকে না পেয়ে ফিরে ফিরে আসে, কিন্তু তার আনন্দ যে পেয়ছে তার আর ভয় নেই। তাকে দেখা উৎসবের মধ্যে দেখা ; জ্ঞানে নয়, তর্কের মধ্যে নয় । আনন্দের ভিতর দিয়ে ছাড়া কিছুই পাবার উপায় নেই। এই—যে উৎসবের আলোক জ্বলছে একে কি তর্ক করে কোনোমতেই পাওয়া যেত । চোখের মধ্যে আলো পাবার আনন্দ আছে, তাই তো চোখ আলো পায় ; চোখ যে আলোর জন্য লালায়িত । এক সময়ে জীবের তো চক্ষু ছিল না ; চক্ষু কেমন করে ক্রমে জীবের অভিব্যক্তিতে ফুটল ? জীবের মধ্যে আলোককে পাবার তৃষ্ণা ছিল, দেহীর দেহের পর্দার আড়ালে বিরহীর মতো সেই তৃষ্ণা জেগে ছিল ; তার সেই দীর্ঘ বিরহের তপস্যা সহসা একদিন চক্ষুবাতায়নের ভিতরে সার্থক হল। আলোকের আনন্দদূত তার চোখের বাতায়নে এল । আলোককে পাবার আনন্দের জন্য তপস্যা ছিল ; সেই তপস্যা অন্ধ জীবের অন্ধকার দেহের মধ্যে - চক্ষুকে বিকশিত করে স্বর্গের আলোকের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে। সেই একই সাধনা অন্ধ চৈতন্যের মধ্যে রয়েছে ; আত্মা কঁদছে। সেখানে । যতদিন পর্যন্ত অন্ধ জীব চক্ষু পায় নি সে জানত না তার ভিতরে আলোকবিরহী কঁদেছিল ; সে না জানলেও সেই কান্না ছিল বলেই চোখ খুলেছে। অন্তরের মধ্যে চৈতন্যগুহায় অন্ধকারের পরামজ্যোতির জন্য মানুষের তপস্যা চলেছে। এ কথা কখনোই সত্য নয় যে কোনো মানুষের আত্মা ধনজনের জন্য লালায়িত । মগ্নচৈতন্যের অন্ধকারময় রুদ্ধ বাতায়নে বিরহী আত্মা কঁদছে ; সেই কান্না সমস্ত কোলাহলের আবরণ ভেদ করে নক্ষত্ৰলোক পর্যন্ত উঠেছে । আনন্দ যেদিন আসবে সেদিন চোখ মেলে দেখব। সেই জ্যোতির্ময়াকে । সেদিন তিনি আমার ভবনে আসবেন এবং বিশ্বভুবনে তার সাড়া পড়ে যাবে। সায়ংকাল, ৭ পৌষ ১৩২১ TS SV)SS অন্তরতর শান্তি তুমি যে, চেয়ে আছ আকাশ ভরে, নিশিদিন অনিমেষে দেখিছ মোরে ! তিনি যে চেয়ে রয়েছেন আমার মুখের দিকে, আমার অন্তরের মাঝখানে, এ কি উপলব্ধি করব। এইখানে । এ-সব কথা কি এই কোলাহলে বলবার কথা । তারার আলোকে, স্নিগ্ধ অন্ধকারে, ভক্তের অন্তরের নিস্তৰূলোকে, যখন অনন্ত আকাশ থেকে একটি অনিমেষ নেত্রের দৃষ্টি পড়ে তখন সেই নিঃশব্দ বিরলতার মধ্যেই এই পরম আনন্দের গভীর বাণী জেগে উঠতে পারে- এই কথাই মনে হয় । কিন্তু তা নয়, সেই বিরলতার মধ্যেই যে সাধকের উৎসব সম্পূর্ণ হয় তা কখনোই সত্য নয়। মানুষের এই কোলাহলময় হাটে যেখানে কেনাবেচার বিচিত্ৰ লীলা চলেছে, এরই মধ্যে, এই মুখর কোলাহলের মধ্যেই, তার পূজার গীত উঠছে- এর থেকে দূরে সরে গিয়ে কখনোই তীর উৎসব নয়। আকাশের তারায় তারায় যে সংগীত উঠছে যুগযুগাম্ভর ধরে সে সংগীতের কেবলই পুনরাবৃত্তি চলছে। সেখানে কোনো কোলাহল নেই, ভিড় নেই, ঠেলাঠেলি নেই ; নক্ষত্ৰলোকে যেন বিশ্বরূপ বাউল তার একতারার একটি সুর ফিরে ফিরে বাজাচ্ছে। কিন্তু মানুষের জগতে যে গান উঠছে সে কি একটি তারের সংগীত । কত যুদ্ধবিগ্ৰহ বিরোধ সংগ্রামের কত বিচিত্র তার সেখানে ঝংকৃত হচ্ছে, তার বৈচিত্র্যের সীমা নেই। কিন্তু এই সমস্ত বৈচিত্র্যের মধ্যে, বিরোধের মধ্যে, শান্তির সুর বাজছে। মানুষের চারিদিকে ষড়রিপুর হানাহানি, তাণ্ডবলীলা চলেছে ; কিন্তু এত বেসুর এসে কই এই একটি সুরকে তো লুপ্ত করতে পারলে না ! সকল বিরোধ, সকল বিপ্লব, সকল যুদ্ধবিগ্রহের ভিতর “দিয়ে এই সুর বেজে উঠল : শান্তং শিবং অদ্বৈতং ।