পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ԳoՀ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী পরিশেষের কয়েকটি কবিতা সাময়িক পত্রে গদ্যভূমিকা-সংবলিত আকারে প্রকাশিত হইয়াছিল। নিম্নে গদ্যাংশগুলি মুদ্রিত হইল । অবুঝ মন জাহাজ চলছে, সমুদ্রের জল কেবলই ছলছল করে, আর লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে । একটি ছোটো শিশু ; আমরা আছি আপনি আপন কোণে একটিমাত্র কেদারা নিয়ে, কিন্তু সে আছে সমস্ত ডেক জুড়ে । তার অবুঝ মনখানি অসংলগ্ন অহৈতুক আগ্রহে ফ্যালফেলে চোখের ভিতর দিয়ে বিশ্বের পরিচয় নিচ্ছে । আয়ার অঙ্কবিহারী সেই আটদশমাসের শিশুটির খেলা দেখে আমার অনেকটা সময় কাটে । এটা বুঝতে পারছি যে, ওরই ঐ মনটি আদিমকালের বহু পুরাতন । আমার যে মন ওকে দেখছে আর ভাবছে, সেই হল নূতন ; অনেক চেষ্টায় অনেক শিক্ষায় ও সাধনায় এই বিচারবুদ্ধিমান মন গড়ে উঠছে, এখনো সে অসমাপ্ত । ওরই অবচেতন মনটির সঙ্গে মেলে গাছপালার মধ্যে যে নির্বোিধ মন জলের দিকে তার শিকড় চালাচ্ছে, সূর্যের দিকে যার আকুতি, যা স্বপ্নচালিতের মতো আপন ফুলের ভিতর দিয়ে আপন ফলের উদ্দেশ্য সাধন করে । আমার নতুন মন গাছপালার মধ্যে ঐ পুরাতন সহজ মন দেখে গভীর শান্তি পায়, আনন্দিত হয় । শিশুর মধ্যেও সেই আদিম মনটি দেখতে তার এত ভালো লাগে । মেয়েদের প্রকৃতিতেও মনের এই আদিমতার প্রাধান্য, তাদের সহজ বোধ সহজ প্ৰবৃত্তি বিচারবুদ্ধির চেয়ে অনেক প্রবল। আমরা অনেকদিন থেকে ওদের সরলা অবলা বলে আসছি, সে কথার মানেই ঐ— যে-তর্কে দ্বিধা আনে ওদের স্বভাবে ভালো করে সেই তর্কবুদ্ধি দখল পায় নি । নতুন-বুদ্ধিওয়ালা পুরুষের মনের কাছে এই সহজ মনের সংস্পৰ্শ আরামের । নতুন-বুদ্ধিওয়ালা মনটা ক্লান্ত করে, বিভ্ৰান্ত করে, সংশয়ে আন্দোলিত করে ; এইজন্যে মানুষ অনেকসময় মদ খায়, এই উদগ্রবুদ্ধিমান মনটাকে বিহবল করে দিয়ে সেই আপন আদিম অবোধ মনের মধ্যে ছুটি নিতে চায়, যেখানে অরাজকতা । শিশুর মধ্যে যাকে দেখছি, সেই আদিম মনটাকে আর-এক জায়গায় দেখছি যেখানে গণসংঘ । সেই গণেশের হাতির মুণ্ড, তার যুথবুদ্ধির মাথা, সে বশ মানতেও যেমন, মেতে উঠতেও তেমনি । তার প্রকাণ্ড শক্তির সঙ্গে তার নীরব বশ্যতার মিল পাই নে, তেমনি তার অকস্মাৎ দুর্দামতারও হিসেব পাওয়া যায় না । সেই অবুঝ মনটার সংস্কারগুলো, তার সমস্ত অন্ধ প্রবর্তন গণসম্প্রদায়কে ঠেলে নিয়ে চলে । তারাই হল বাহন। নতুন মনটা সারথিগিরি করতে চেষ্টা করে, কিন্তু ঘোড়া প্রায়ই চার পা তুলে ছোটে । নইলে যুরোপে সেদিন যে যুদ্ধকাণ্ড হয়ে গেল, তা হতে পারত না । আদিম মনটা যখন বুদ্ধিওয়ালা মনটাকে একেবারেই মানতে চায় না, তখন মানুষ যাকে সভ্যতা বলে তার ঘটে দুৰ্গতি । প্ৰাচীন গ্ৰীস তার অসামান্য বুদ্ধি সত্ত্বেও যদি মরে থাকে, তার কারণটা ছিল। অবচেতন মনের মধ্যে, যেখানে তার গুহাচর প্রবৃত্তির, তার গর্তবাসী সংস্কারের বাসা । আজকের দিনে যুরোপ কোনোমতেই স্থায়ী শান্তির কোনো ব্যবস্থা করতে পারছে না, তার কারণ সংস্কারগুলো লাগাম দাতে চেপে ধরে ছুটিতে চায় । সভ্যতা এর উলটো কারণেও মরে । নতুন মন যখন সনাতন সহজ মনের শক্তিকে আপনি জটিল কর্মজলে সম্পূর্ণ চাপা দিতে চায়, আপন রথের চাকার তলায় তাকে খণ্ড খণ্ড করে, তখন তার শক্তির আদিম আশ্রয় জীৰ্ণ হয়ে যায়। আকাশগামী চুড়াটা ধুলোর আশ্রয় ছাড়িয়ে উঠতে চায়; ক্ষতি নেই, কিন্তু যখন সামঞ্জস্যের সীমা অতিক্রম করে তখনি ফিরে তাকে সেই ধুলোয় এসে পড়তে হয় । আদিম অবুঝ মনের সঙ্গে নতুন বুদ্ধিমান মনের পদে পদে রফা-নিম্পত্তি করে চলাই পাকাচালে চলা । এই তো গেল আমার চিন্তার কথা । কিন্তু শিশুর মুখের দিকে যখন তাকিয়ে দেখতুম, তখন যে-আনন্দ বোধ করতুম সেটা চিন্তার আনন্দ নয় ; তখন আমি বিশ্বব্যাপী আদিম প্ৰাণের বৃহৎ রঙ্গলীলা শিশুর দুটি চোখের বুদ্ধিবিহীন চঞ্চল ঔৎসুক্যের মধ্যে দেখতে পেতুম। শিশুর মধ্যে সেই বিশ্বশিশুকে দেখার আনন্দেই এই কবিতাটি লিখেছি । -বিচিত্রা, অগ্রহায়ণ ১৩৩৪