পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

A or রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী নুতন কাল --- আমরা যারা এখানে [[বালীদ্বীপে] বাহির থেকে এসেছি, আমাদের একটা দুর্লভ সুবিধা ঘটেছে এই যে, আমরা অতীত কালকে বর্তমানভাবে দেখতে পাচ্ছি। সেই অতীত মহৎ, সেই অতীতের ছিল প্ৰতিভা, যাকে বলে নবনবোন্মেষশালিনী বুদ্ধি ; তার প্রাণশক্তির বিপুল উদ্যম আপন শিল্পীসৃষ্টির মধ্যে প্রচুরভাবে আপন পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু তবুও সে অতীত, তার উচিত ছিল বর্তমানের পিছনে পড়া, সামনে এসে দাড়িয়ে বর্তমানকে সে ঠেকিয়ে রাখল কেন । বর্তমান সেই অতীতের বাহনমাত্র হয়ে বলছে ‘আমি হার মানলুম ; সে দীনভাবে বলছে, “এই অতীতকে প্রকাশ করে রাখাই আমার কাজ, নিজেকে লুপ্ত করে দিয়ে।” নিজের পরে বিশ্বাস করবার সাহস নেই। এই হচ্ছে নিজের শক্তি সম্বন্ধে বৈরাগ্য, নিজের পরে দাবি যতদূর সম্ভব কমিয়ে দেওয়া । দাবি স্বীকার করায় দুঃখ আছে, বিপদ আছে, অতএব- বৈরাগ্যমেবাভয়ং, অর্থাৎ বৈনাশ্যমেবাভয়ং । --- এখানে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় এত অসম্ভবরকম ব্যয় হয় যে সুদীর্ঘকাল লাগে তার আয়োজনে- যম আপন কাজ সংক্ষেপে ও সস্তায় সারেন। কিন্তু নিয়ম চলে অতি লম্বা ও দুর্মুল্য চালে। এখানে অতীতকালের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলেছে বহুকাল ধরে, বর্তমানকালকে আপনি সর্বস্ব দিতে হচ্ছে তার ব্যয় বহন করবার জন্যে । এখানে এসে বার বার আমার এই কথা মনে হয়েছে যে, অতীতকাল যত বড়ো কালই হােক নিজের সম্বন্ধে বর্তমান কালের একটা স্পর্ধা থাকা উচিত, মনে থাকা উচিত তার মধ্যে জয় করবার শক্তি আছে । এই ভাবটাকে আমি একটি ছোটো কবিতায় লিখেছি।-- —জাভা-যাত্রীর পত্র । ৩০ অগস্ট, ১৯২৭ “উত্তিষ্ঠত নিবোধত কবিতাটির ব্যাখ্যাস্বরূপ রবীন্দ্রনাথ রমা দেবীকে নিম্নমুদ্রিত পত্রটি (১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪০) লিখিয়াছিলেন : যে-আশীর্বাদ তোমাকে পাঠালুম এখনি তার সম্পূর্ণ অর্থ বুঝতে পারবে না, তাতে ক্ষতি নেই, রইল তোমার কাছে । এর মধ্যে যে কথাটি আছে। সংক্ষেপে তার অর্থ এই, ঈশ্বরের কাছ থেকে দানরূপে পেয়েছি। আমাদের এই জীবন, একে যদি হেলা করে নষ্ট না করি, নিজের চেষ্টায় একে যদি ভালো করতে পারি, সুন্দর করতে পারি, তা হলেই এই দান সার্থক হবে- নইলে এত বড়ো ঐশ্বৰ্য পেয়েও হারানো হবে । “উত্তিষ্ঠত নিবোধত এই মন্ত্রের অর্থ এই— “ওঠে, জাগো ।” জীবনকে সত্য করে তুলতে হলে সচেতন থেকে তার সাধনা করতে হয়। “প্রবাসী’ কবিতাটিকে ভাঙিয়া পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ স্বতন্ত্র দুটি গান রচনা করিয়াছিলেন ; প্রথম-সংস্করণ গীতবিতানের তৃতীয় খণ্ডে ‘পরবাসী চলে এসো ঘরে (পৃ ৭৯০) এবং ‘এসো এসো প্ৰাণের উৎসবে” (পৃ ৮৪৪) গানদুটি দ্রষ্টব্য। ‘নূতন’ কবিতাটিরও একটি পরিবর্তিত সংগীতরূপ প্রথম সংস্করণ গীতবিতানে (পৃ ৮৪৪) পাওয়া যায় । গানটির প্রথম ছত্ৰ- “দুর রজনীর স্বপন লাগে । উল্লিখিত গানগুলি অধুনা প্রচলিত গীতবিতানের বিভিন্ন অংশে পাওয়া যাইবে । পুনশ্চ পুনশ্চ ১৩৩৯ সালের আশ্বিন মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৩৪০ সালের ফান্ধুন প্ৰকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে, পরিশেষ গ্ৰন্থ হইতে— খেলনার মুক্তি, পত্ৰলেখা, খ্যাতি, বাঁশি, উন্নতি, ভীরু এবং নুতন-লিখিত তীর্থযাত্রী, চিররাপের বাণী, শুচি, রঙরেজিনী, মুক্তি, প্রেমের সোনা ও স্নানসমাপন এই তেরোটি কবিতা সংযোজিত হয় । রবীন্দ্র-রচনাবলীর এই খণ্ডে উক্ত দ্বিতীয় সংস্করণই পুনর্মুদ্রিত হইল।