পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

'SNe রবীন্দ্র-রচনাবলী ঘরে প্রবেশ করাও যেমন শক্ত, ঘর হইতে অবিলম্বে বাহির হওয়াও তেমনি কঠিন। নিবারণ একটু এদিকে ওদিকে চাহিয়া ইতস্তত করিয়া বলিল, “তবে অন্যত্র চেষ্ট দেখিগে যাই”, বলিয়া প্রস্থান করিল। ঋণ কোথায় এবং কোথায় গহনা বন্ধক দিতে হইবে হুরসুন্দরী তাহ সমস্তই বুৰিল। বুঝিল, নববধূ পূর্বরাত্রে তাহার এই হতবুদ্ধি পোষা পুরুষটিকে অত্যন্ত ংকার দিয়া বলিয়াছিল, “দিদির সিন্দুকভরা গহনা, আর আমি বুঝি একখানি পরিতে পারি না ।” নিবারণ চলিয়া গেলে ধীরে ধীরে উঠিয়া লোহার সিন্দুক খুলিয়া একে একে সমস্ত গহনা বাহির করিল। শৈলবালাকে ডাকিয়া প্রথমে আপনার বিবাহের বেনারসি শাড়িখানি পরাইল, তাহার পর তাহার আপাদমস্তক এক-একখানি করিয়া গহনায় ভরিয়া দিল। ভালো করিয়া চুল বাধিয়া দিয়া প্রদীপ জালিয়া দেখিল, বালিকার মুখখানি বড়ো সুমিষ্ট, একটি সদ্যঃপক্ক সুগন্ধ ফলের মতো নিটোল রসপূর্ণ। শৈলবালা যখন ঝমঝম শব্দ করিয়া চলিয়া গেল, সেই শস্ব বহুক্ষণ ধরিয়া হরসুন্দরীর শিরার রক্তের মধ্যে বিমঝিম করিয়া বাজিতে লাগিল। মনে মনে কহিল, আজ আর কী লইয়া তোতে আমাতে তুলনা হইবে । কিন্তু এক সময়ে আমারও তো ওই বয়স ছিল, আমিও তো আমনি যৌবনের শেষরেখা পর্যস্ত ভরিয়া উঠিয়াছিলাম, তবে আমাকে সে কথা কেহ জানায় নাই কেন। কখন সেদিন আসিল এবং কখন সেদিন গেল তাহা একবার সংবাদও পাইলাম না। কিন্তু কী গর্বে, কী গৌরবে, কী তরঙ্গ তুলিয়া শৈলবালা চলিয়াছে। ‘হরসুন্দরী যখন কেবলমাত্র ঘরকন্নাই জানিত তখন এই গহনাগুলি তাহার কাছে কত দামি ছিল। তখন কি নির্বোধের মতে এ সমস্ত এমন করিয়া একমুহূর্তে হাতছাড়া করিতে পারিত। এখন ঘরকন্ন ছাড়া আর একটা বড়ো কিসের পরিচয় পাইয়াছে, এখন গহনার দাম ভবিষ্যতের হিসাব সমস্ত তুচ্ছ হইয়া গিয়াছে। আর শৈলবালা সোনামানিক ঝকমক করিয়া শয়নগৃহে চলিয়া গেল, একবার মুহূর্তের তরে ভাবিলও না হরমুন্দরী তাহাকে কতখানি দিল । সে জানিল চতুর্দিক হইতে সমস্ত সেবা, সমস্ত সম্পদ, সমস্ত সৌভাগ্য স্বাভাবিক নিয়মে তাহার মধ্যে আসিয়া পরিসমাপ্ত হইবে, কারণ, সে হইল শৈলবালা, সে হইল সই।