পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ :ፃፃ এদিকে রাজকন্যা সোনার পালঙ্কে একটি ধবধবে ফুলের বিছানা পাতিলেন, ঘরে সোনার প্রদীপে মুগন্ধ তেল দিয়া বাতি জালাইলেন এবং চুলটি বাধিয়া নীলাম্বর কাপড়টি পরিয়া সাজিয়া বসিয়া প্রহর গনিতে লাগিলেন, কখন রাত্রি আসে । রাত্রে তাহার স্বামী কোনোমতে আহার শেষ করিয়া শয়নগৃহে সোনার পালঙ্কে ফুলের বিছানায় গিয়া শয়ন করিলেন। ভাবিতে লাগিলেন, আজ শুনিতে পাইব এই সাতমহলা বাড়িতে যে সুন্দরটি থাকে সে আমার কে হয়। Eil রাজকতা তাহার স্বামীর পাত্রে প্রসাদ খাইয়া ধীরে ধীরে শয়নগৃহে প্রবেশ করিলেন । আজ বহুদিন পর প্রকাশ করিয়া বলিতে হুইবে, সাতমহলা বাড়ির একমাত্র অধীশ্বরী } আমি তোমার কে হুই । বলিতে গিয়া বিছানায় প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, ফুলের মধ্যে সাপ ছিল, তাহার স্বামীকে কখন দংশন করিয়াছে। স্বামীর মৃতদেহখানি মলিন হুইয়া সোনার পালঙ্কে পুষ্পশয্যায় পড়িয়া আছে । আমার যেন বক্ষঃস্পন্দন হঠাৎ বন্ধ হইয়া গেল। আমি রুদ্ধস্বরে বিবর্ণমুখে জিজ্ঞাসা করিলাম, তার পরে কী হুইল । দিদিমা বলিতে লাগিলেন, তার পরে— কিন্তু সে-কথায় আর কাজ কী । সে যে আরও অসম্ভব। গল্পের প্রধান নায়ক সর্পাঘাতেই মারা গেল, তবুও তার পরে ? বালক তখন জানিত না, মৃত্যুর পরেও একটা তারপরে থাকিতে পারে বটে, কিন্তু সে ‘তার-পরে’র উত্তর কোনো দিদিমার দিদিমাও দিতে পারে না । বিশ্বাসের বলে সাবিত্রী মৃত্যুরও অঙ্কগমন করিয়াছিলেন । শিশুরও প্রবল বিশ্বাস। এইজন্য সে মৃত্যুর অঞ্চল ধরিয়া ফিরাইতে চায়, কিছুতেই মনে করিতে পারে না যে, তাহার মাস্টারবিহীন এক সন্ধ্যাবেলাকার এত সাধের গল্পটি হঠাৎ একটি সর্পাঘাতেই মারা গেল। কাজেই দিদিমাকে সেই মহাপরিণামের চিরকুদ্ধ গৃহ হইতে গল্পটিকে আবার ফিরাইয়া আনিতে হয়। কিন্তু এত সহজে সেটি সাধন করেন, এমন অনায়াসে—কেবল হয়তো একটা কলার ভেলায় ভাসাইয়া দিয়া গুটি দুই মন্ত্ৰ পড়িয়া মাত্র—ষে সেই ঝুপ কুপ বৃষ্টির রান্ত্ৰে স্তিমিত প্রদীপে বালকের মনে মৃত্যুর মূর্তি অত্যন্ত অকঠোর হইয়া আসে, তাহাকে এক রাত্রের মুখনিক্সার চেয়ে বেশি মনে হয় না । গল্প যখন ফুরাইরা যায়, আরামে শ্রান্ত দুটি চক্ষু আপনি মুদিয়া আসে, তখনও তো শিশুর ক্ষুত্র প্রাণটিকে একটি স্নিগ্ধ নিস্তন্ধ নিস্তরঙ্গ স্রোতের মধ্যে স্বযুপ্তির ভেলায় করিয়া ভাসাইয়া দেওয়া হয়, তার পরে ভোরের বেলায় কে দুটি মায়ামন্ত্ৰ পড়িয়া তাহাকে এই জগতের মধ্যে জাগ্ৰত করিয়া তোলে।