পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩২২ রবীন্দ্র-রচনাবলী সংকুচিত হইয়া গেল—মনে হইল পৃথিবী দ্বিধা হইলে তবে সে লঙ্গ রক্ষা করিতে পারে । বহুদিন আর সে লেখে নাই। কিন্তু একদিন শরৎকালের প্রভাতে একটি গায়িক ভিখারিনী আগমনীর গান গাহিতেছিল। উমা জানালার গরীদের উপর মুখ রাখিয়া চুপ করিয়া শুনিতেছিল। একে শরৎকালের রৌদ্রে ছেলেবেলাকার সকল কথা মনে পড়ে, তাহার উপরে আগমনীর গান গুনিয়া সে আর থাকিতে পারিল না । উমা গান গাহিতে পারিত না ; কিন্তু লিখিতে শিখিয়া অবধি এমনি তাহার অভ্যাস হইয়াছে যে, একটা গান শুনিলেই সেটা লিখিয়া লইয়া গান গাহিতে না পারার খেদ মিটাইত। আজ কাঙালি গাহিতেছিল— “পুরবাসী বলে উমার মা, তোর হারা তারা এল ওই । শুনে পাগলিনীপ্রায়, অমনি রানী ধায়, কই উমা বলি কই । কেঁদে রানী বলে, আমার উমা এলে, একবার আয় মা, একবার আয় মা, একবার আয় মা করি কোলে। অমনি দুবাহু পসারি, মায়ের গলা ধরি অভিমানে কঁাদি রানীরে বলে— কই মেয়ে বলে আনতে গিয়েছিলে ।” অভিমানে উমার হৃদয় পূর্ণ হইয়া চোখে জল ভরিয়া গেল। গোপনে গায়িকাকে ডাকিয়া গৃহদ্বার রুদ্ধ করিয়া বিচিত্র বানানে এই গানটি খাতায় লিখিতে আরম্ভ করিল। তিলকমঞ্জরী, কনকমঞ্জরী এবং অনঙ্গমঞ্জরী সেই ছিদ্ৰযোগে সমস্ত দেখিল এবং সহসা করতালি দিয়া বলিয়া উঠিল, “বউদিদি, কী করছ আমরা সমস্ত দেখেছি।” তখন উমা তাড়াতাড়ি দ্বার খুলিয়া বাহির হইয়া কাতরস্বরে বলিতে লাগিল, “লক্ষ্মী ভাই, কাউকে বলিসনে ভাই, তোদের দুটি পায়ে পড়ি ভাই—আমি আর করব না, আমি আর লিখব না।” অবশেষে উমা দেখিল, তিলকমঞ্জরী তাহার খাতাটির প্রতি লক্ষ্য করিতেছে। তখন সে ছুটিয়া গিয়া খাতাটি বক্ষে চাপিয়া ধরিল । ননদীর অনেক বল প্রয়োগ করিয়া সেটা কাড়িয়া লইবার চেষ্টা করিল, কৃতকার্ধ না হইয়া অনঙ্গ দাদাকে ডাকিয়া আনিল ।