পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উপবীতচিহের বার সমাজে অধিকারভেদ নির্দিষ্ট হয় বলিয়া বাহার উপবীতধারণকে নিন্দ করেন তাহারা কি এ কথা চিন্তা-করিবেন না যে, অদৃশু উপবীত দৃপ্ত উপবীতের চেয়ে অনেকগুণে দৃঢ় ? “উন্নতিশীল ব্রাহ্ম" নামের পৈতাটা উচ্চ করিয়া তুলিয়া বরিয়া তত্ত্বকৌমুদীয় সম্পাদক মহাশয় ষে জাত্যভিমান, যে কৌলীন্তগর্ব প্রকাশ করিয়াছেন, জিজ্ঞাসা করি, তাহা কি সর্বপ্রকার কুসংস্কারবর্জিত ? উন্নতিশীল ব্রাহ্মগণ কেবলমাত্র উন্নতিশীলতার বেগে হিন্দুত্বের সংকীর্ণ গৰ্ত্তী অনেক কাল হইল কাটাইয়াছেন বলিয়া সম্পাদক মহাশয় গৌরব প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু ষে গণ্ডী আমাদের স্বরচিত ও কৃত্রিম নহে তাহা আমরা কাটাইতে পারি না। যেমন আমার একটা দেহের গণ্ডী আছে। এই গণ্ডীকে আশ্রয় করিয়া আমি একটি বিশেষ স্বাতন্ত্র্য লাভ করিয়াছি; এই স্বাতন্ত্র্য যদি আমার উন্নতির প্রতিকুল ও আমার অপরাধ বলিয়া গণ্য হয় তবে বিশ্বের সহিত একাকার হইবার চেষ্টায় পঞ্চব্ৰলাভ ছাড়া আমার অন্ত কোনো গতি থাকে না । গণ্ডীর পরে গণ্ডী, চক্রের পরে চক্র কাটিয়া বিধাতা এই জগৎ স্বষ্টি করিয়াছেন। পৃথিবীর গণ্ডী পৃথিবীর, স্থধের গণ্ডী স্বর্ণের, তৃণের গণ্ডী তৃণের, মানুষের গণ্ডী মানুষের । স্বাভাবিক গণ্ডীর বিরুদ্ধে লড়াই করাই যে উন্নতিশীলতার লক্ষণ এ কথা মনে করি না । আবার আমাদের স্বরচিত গণ্ডীও আছে। কেননা, বিধাতার স্বষ্টিকার্ধেও যেমন মাচুষের স্বষ্টিকার্ধেও তেমনি – গওঁ দিয়া দিয়াই গড়িয়া তুলিতে হয়। মানুষের ঘরবাড়ি একটা গতী, তাহার পরিবার একটা গতী, তাহার ব্যবসায় একটা গণ্ডী। প্রত্যেক গণ্ডীর মধ্যে বিশিষ্টতা আছে, সেই বিশিষ্টতার দ্বারা মানুষ আপন ঘরে আপন পরিবারে আপন ব্যবসায়ে স্বতন্ত্র । এমন কি সামান্ত ছাতাজুতা ঘটিবাটিও সরকারী নহে, এবং কেহ তাহাকে সরকারী করিবার চেষ্টা করিলেই থানায় খবর দিতে হয়। তাই যদি হইল তবে সর্বজনীনতা বলিয়া একটা পদার্থ কি একেবারেই আকাশকুসুম ? যদি সকলপ্রকার গণ্ডীকে, সকলপ্রকার বিশিষ্টতাকে একেবারে অস্বীকার করাকেই সর্বজনীনতা বলে তবে সর্বজনীনতা বস্তুতই আকাশকুসুম সন্দেহ নাই। 'ভাইকে মানি না কিন্তু ভ্রাতৃভাবকে মানি, এ কথাটাও যেমন তেমনি সর্বজনকে বিশেষ বলিয়া মানি না একটা নির্বিশেষ সর্বজনীনতাকে মানি ইহাও সেইরূপ মাথা-নেই-তারমাধা-ব্যথা। প্রত্যেকের বিশিষ্টত আছে বলিয়াই সেই অগণ্য বিশিষ্টতার মধ্যে ঐক্য উপলব্ধি করার সাধন সর্বজনীনতা—নতুবা তাহার কোনো প্রয়োজন নাই। বিশিষ্টতাকে স্বীকার করা যে কুসংস্কার এইরূপ স্বইছাড় কথাই অন্ধ সংস্কার। অতএব হিন্দুত্বের