পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰবন্ধ SOC করে থাকেন। এরকম ক্ষেত্রে মতের ঐক্য কখনাে সত্য হতে পারে না, বস্তুত প্রতিকূলতাই অনেক সময়ে শ্রেষ্ঠতার প্রমাণরূপে দাঁড়ায়। কিন্তু নিকট থেকে নানা অবস্থায় মানুষটিকে ভালো করে জািনবার সুযোগ আমি পেয়েছি। এই সুযোগে যে-মানুষটি ছবি আঁকেন তাকে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা করেছি বলেই তীর ছবিকেও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতে পেরেছি। এই শ্রদ্ধায় যে-দৃষ্টিকে শক্তি নন্দলালকে সঙ্গে করে নিয়ে একদিন চীনে জাপানে ভ্ৰমণ করতে গিয়েছিলুম। আমার সঙ্গে ছিলেন আমার ইংরেজ বন্ধু এলমহাস্ট। তিনি বলেছিলেন, নন্দলালের সঙ্গ একটা এডুকেশন। তীর সেই কথাটি একেবারেই যথার্থ। নন্দলালের শিল্পদূষ্টি অত্যন্ত খাঁটি, তীর বিচার-শক্তি অন্তর্দশী একদল লোক আছে আটকে যারা কৃত্রিম শ্রেণীতে সীমাবদ্ধ করে দেখতে না পারলে দিশেহারা হয়ে যায়। এইরকম করে দেখা খোড়া মানুষের লাঠি ধরে চলার মতে, একটা বাঁধা বাহা আদর্শের উপর ভর দিয়ে নজির মিলিয়ে বিচার করা। এইরকমের যাচাই-প্ৰণালী মুজিয়ম সাজানাের কাজে লাগে। যে জিনিস মরে গেছে তার সীমা পাওয়া যায়, তার সমস্ত পরিচয়কে নিঃশেষে সংগ্ৰহ করা সহজ, তাই বিশেষ ছাপ মেরে তাকে কোঠায় বিভক্ত করা চলে। কিন্তু যে আর্ট অতীত ইতিহাসের স্মৃতিভাণ্ডারের নিশ্চল পদার্থ নয়, সজীব বর্তমানের সঙ্গে যার নাড়ীর সম্বন্ধ, তার প্রবণতা ভবিষ্যতের দিকে; সে চলেছে, সে এগোচ্ছে, তার সস্তুতির শেষ হয় নি, তার সত্তার পাকা দলিলে অস্তিম স্বাক্ষর পড়ে নি! আর্টের রাজ্যে যারা সনাতনীর দল তারা মৃতের লক্ষণ মিলিয়ে জীবিতের জন্যে শ্রেণীবিভাগের বাতােয়নহীন কবর তৈরি করে। নন্দলাল সে জাতের সেইজনাই তীর সঙ্গ এডুকেশন। যারা ছাত্ররূপে তার কাছে আসবার সুযোগ পেয়েছে তাদের আমি ভাগ্যবান বলে মনে করি— তার এমন কোনো ছাত্র নেই। এ কথা যে না অনুভব করেছে এবং স্বীকার না করে। এ সম্বন্ধে তিনি তার নিজের গুরু অবনীন্দ্রনাথের প্রেরণা আপন স্বভাব এবং তাতে তিনি কৃতকার্য হন যেহেতু তীর নিজের মধ্যেই সেই মুক্তি আছে। কিছুদিন হল, বােম্বায়ে নন্দলাল তীর বর্তমান ছাত্রদের একটি প্রদর্শনী খুলেছিলেন। সকলেই জানেন, সেখানে একটি স্কুল অফ আর্টস আছে, এবং এ কথাও বোধ হয় অনেকের জানা আছে, আসছেন। তঁদের নালিশ এই যে, আমাদের শিল্পীসৃষ্টিতে আমরা একটা পুরাতন চালের ভঙ্গিমা সৃষ্টি করেছি, সে কেবল সস্তায় চােখ ভোলাবার ফন্দি, বাস্তব সংসারের প্রািণবৈচিত্র্য তার মধ্যে নেই। আমরা কাগজেপত্রে কোনো প্ৰতিবাদ করি নি- ছবিগুলি দেখানো হল। এতদিন যা বলে তারা বিদ্রপ করে এসেছেন, প্রত্যক্ষ দেখতে পেলেন তার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ প্ৰমাণ। দেখলেন বিচিত্র না আছে আধুনিকের; তা ছাড়া কোনাে ছবিতেই চলতি বাজারদরের প্রতি লক্ষ্যমাত্র নেই। যে নদীতে স্রোত অল্প সে জড়ো করে তোলে শৈবালন্দামের বৃহ, তার সামনের পথ যায় রুদ্ধ হয়ে। তেমন শিল্পী সাহিত্যিক অনেক আছে যারা আপন অভ্যাস এবং মুদ্রাভিঙ্গির দ্বারা আপন আচল সীমা রচনা করে তোলে। তাদের কর্মে প্রশংসাযোগ্য গুণ থাকতে পারে। কিন্তু সে আর বঁােক ফেরে না, এগোতে চায় না, ক্রমাগত আপনারই নকল আপনি করতে থাকে, নিজেরই কৃতকর্ম থেকে তার নিরস্তর নিজের চুরি চলে। আপন প্রতিভার যাত্রাপথে অভ্যাসের জড়ত্ব দ্বারা এই সীমাবন্ধন নন্দলাল কিছুতেই সহ করতে পারেন না। আমি তা জানি। আপনার মধ্যে র্তার এই বিদ্রোহ কতদিন দেখে আসছি। সর্বত্রই এই বিদ্রোহ সৃষ্টিশক্তির অন্তর্গত। যথার্থ সৃষ্টি বাঁধা রাস্তায় চলে না, প্ৰলয়৷শক্তি কেবলই