পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S \o রবীন্দ্র-রচনাবলী মানুষ এ কথাই মনে করে। সেই সময় বাইরের আবরণটাকে সরিয়ে ফেলতে চান যারা, তাদের তখন বিরুদ্ধবাদী বলে মনে হয়। ভারতবর্ষের অন্তর্নিহিত পুরাতন ঋষিবাক্য উদ্ধার করবার জন্য ব্ৰহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র এসেছিলেন। স্বাদেশিকতার গণ্ডির বাহিরে তাকে অনেকদিন ধরে রেখেছিলাম, কিন্তু তা আর রইল না। আমরা ভারতবর্ষের লোক, আমরা সমুদ্রের এত কাছে জন্মগ্রহণ করেছি যে নীেকা একটুখানি নদীতে বেয়ে গেলেই সমুদ্রে গিয়ে পড়ি। তাই বুঝতে পারলাম কোনো মহাপুরুষ কেবলমাত্র জন্মাতে পারেন না আঘাত করতে। আমার সেটি মনে হল আমাদের দেশেতে অনেক বড়ো কথা ঋষিরা বলে গিয়েছেন তার মধ্যে সবচাইতে পুরাতন সেই দাঁড়িয়ে যে বলেছিলেন যোদেবাগ্নেী যোহপসু যোবিশ্বং ভূবনমাবিবেশি। যওষধীয়ু যৌবনস্পতিযু তস্মৈ দেবায় নমোনমঃ৷৷ যিনি সর্বত্র রয়েছেন, যিনি আকাশ বায়ু জলে রয়েছেন, যিনি ঔষধিপত্রপল্লবপূর্ণ বনস্পতিতে রয়েছেন তঁকে নমস্কার করি।” কোনো একটা সংস্কারে হৃদয়ের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত কোনো একটা বিশেষ স্থানে আমাদের ভক্তি আসে। সকল স্থানে আসে না যখন তখনই বুঝতে পারি। আমাদের সে শক্তি নাই। সেই সর্বশক্তিমানকে দূরে বলে মানুষ মনে করত। সেই যে মোহ কেটে গেল, তাতে কতখানি একটা চৈতন্য হয়েছে তখন যাঁরা দেখেছেন, তঁরাই বুঝতে পারেন। এখন বিজ্ঞানের আলোকে দেখা যায় এক শক্তি সর্বত্র। তখন ঋষিরা দিব্যলোকে সর্বত্র সেই শক্তিকে অনুভব ক’রে সকলকে নমস্কার করলেন। সেইরকম আর-একটি জিনিস আছে, ইতিহাসে, জাতিতে, ধর্মে, আমরা কত অনৈক্য দেখতে পাই, কিন্তু সব মিলিয়ে একজন রয়েছেন এটা দেখতে বিশেষ চৈতন্য দরকার। সপৰ্য্যাগাচ্ছক্ৰেমকাষমব্ৰণমস্নাবিরং, শুদ্ধমপাপবিদ্ধং। কবিৰ্ম্মনীষী পরিভৃঃ স্বয়ত্ত্বর্যাথাতথ্যতোর্থন ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভাঃ সমাভ্যঃ৷ যিনি বিধাতা, তিনি বিধান করলেন— তিনি কবি— আনন্দে সমস্ত বিশ্বসংসারকে সৃষ্টি করলেন। তিনি মনীষী— মনকে তিনি শাসন করছেন। অব্যাহত তার কবিত্ব প্রকাশ হচ্ছে, তীর সৃষ্টিতে, র্তার ঐশী-শক্তি প্ৰকাশ হচ্ছে আমাদের মনের মধ্যে। আমাদের ইচ্ছার উপর তঁর ইচ্ছা জয়ী হচ্ছে তাই তিনি মনীষী। তিনি কবি ও মনীষী। তার বিধান অনস্তকালের বিধান। সেই কথা যে মহাপুরুষ প্রকাশ করেছেন, সর্বোচ্চ বাণী তিনি জীবনের মধ্য দিয়ে নূতন করে প্রকাশ করেছেন। নববিধান পুরাতনকে নূতন ক’রে গ্রহণ করে প্রকাশ করা। কোনাে পুরাতন জিনিসকে নুতন করে যখন কেউ দেখতে চাইবে না, কখনো তীরা সে জিনিসে কিছু নূতন দেখতে পারেন না। প্রভাতকাল অতি পুরাতন, দিবা রাত্রি সূর্য চন্দ্র গ্রহমণ্ডল অতি পুরাতন, প্রত্যহ আসা-যাওয়া করছে। কিন্তু কবি যখন একদিন প্ৰভাতকে নূতন ভাবে দেখতে পান, তখন তিনি মনে করেন, এ বুঝি কখনাে আগে দেখেন নি, এমনটি বুঝি কেউ কখনো দেখে নি। ভারতবর্ষে যে সাধনা করে যে সত্যকে লাভ করেছে আমরা বলব তিনি তা স্নান করতে দাঁড়িয়েছেন? আমরা বিরোধ দ্বারা কিছুতেই তঁকে গ্ৰহণ করতে পারব না। আমরা অন্য ধর্মকে ঘূণা করতে আরম্ভ করেছি, সেই সত্যের বিদ্রোহ পতাকা আমরা তুলেছি, যিনি সে সত্যকে প্রচার করতে দাঁড়িয়েছেন তীকে আমরা শত্রু বলে মনে করি! গুরুন্নানক, মহম্মদ প্রভৃতিকেও বিরুদ্ধবাদী বলে মনে করেছি। আমাদের যেটুকু সাধনা সেটুকু নিয়েই আমরা নিজের ধর্মমন্দিরের মধ্যে, নিজের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকি। তাতে আর কারোকে প্রবেশ করিতে দিই না, তা নিয়ে আর কোনো স্থানে যাই না। যিনি সত্যস্বরূপ, তাকে সকল ধর্মের মধ্যে প্রকাশ করা, গ্রহণ করা এই কথা সত্য, ব্ৰহ্মানন্দের মনের কথা এবং তাই নূতন করে তিনি লাভ করে নূতন করে নববিধান বলে প্রকাশ