পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰবন্ধ S\©(፩ \) রামমোহন রায় ভারতবর্ষে নবযুগের উদবোধন করেন। যে যুগে আমাদের দেশ তাহার আত্মার সহিত মহান সত্যের যোগসূত্র হারাইয়া পারিপার্শ্বিক অবস্থার দাসত্বে, বিচারহীনতার দুঃসহ ভারে পিষ্ট হইতেছিল, সেই যুগে রামমোহন আবির্ভূত হন। সামাজিক অনুষ্ঠানে, রাজনীতিতে, ধর্ম ও শিল্পকলায় আমরা সৃষ্টি-ক্ষমতা হারাইয়া ফেলিয়াছিলাম এবং জীবন্ত মানুষের ধর্ম বিস্মৃত হইয়া গতাসু ঐতিহাকেই আঁকড়াইয়া ধরিয়াছিলাম। অধঃপতিত ভারতের এই তামসযুগে সত্যদর্শীর দৃষ্টি লইয়া অপরাজেয় আত্মিক বল লইয়া রামমোহন ভারতের আকাশে দুতিমান জ্যোতিষ্করূপে প্রকাশিত হন। তাহার ভাস্বর বিভায় সমগ্ৰ দেশ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, আত্মবিস্মৃতির দৈন্য হইতে তিনি আমাদিগকে রক্ষা করিলেন। র্তাহার ব্যক্তিত্বের বৈদ্যুতিক শক্তিতে, তাহার আত্মার দুঃসাহসিক তেজস্বিতায় আমাদের জাতীয় সভা সৃষ্টিপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হইল, আমরা আত্মানুভূতির দুৰ্গম পথে পদার্পণ করিলাম। তিনি বর্তমান শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম পথপ্রদর্শক- প্রতি পদবিক্ষেপে যে অলঙ্ঘনীয় বিঘ্ন আমাদের পথরোধ করিতেছিল, তিনিই তাহা উচ্ছেদ করিয়া আমাদিগকে বর্তমান যুগের বিশ্বজনীন সহযোগিতায় দীক্ষা দান করিয়াছেন। শাশ্বত মানবতার বাণী লইয়া যে-সকল আত্মদশী যুগঋষি ভারতবর্ষে আবির্ভূত হইয়াছেন, রামমোহন তঁহাদেরই অন্যতম যুগাচার্য। মনুষ্যত্বের সাধনাপথে ঈশ্বরের অনুভূতি এবং দেশ ও যুগে যুগে যে বিভিন্ন মনুষ্য সম্প্রদায় ভারতবর্ষে প্রবেশ করিয়াছে, উহাদের বৈচিত্র্যে সমন্বয় সাধন করিয়া উহাদের পরস্পরবিরোধী সংস্কৃতিকে একটি সুসামঞ্জস্য রূপ দান মানবেতিহাসের আদিম অধ্যায় হইতেই ভারতের গৌরবও বটে আবার ভারতের সমস্যাও বটে। মানবসভ্যতার আদিম যুগেই যে ভারতবর্ষ এই সমস্যা সমাধানের বিপুল প্রয়াসে বিরাট ব্যবধান সত্ত্বেও প্রত্যেক সম্প্রদায়কে সমাজের উদার বক্ষে আশ্রয় দান করিয়াছিলেন, জটিল জাতিবিভাগ - সংবলিত আমাদের বিশাল সমাজ-দেহই তাহার প্রমাণ। কবীর, নানক, দাদু প্রভৃতি রামমোহনের পূর্ববতী সাধু ও ঋষিগণ জাতি ও পঙক্তির গণ্ডি ভাঙিয়া সমন্বয় প্রয়াসে আরও বহু দূর অগ্রসর হইয়াছিলেন, সামাজিক ও ধর্মগত সংকীর্ণতা চূৰ্ণ করিয়া তাহারা বাস্তব ধর্মের ঐক্যবন্ধনে সকলকে আবদ্ধ করিয়াছিলেন। ঐক্য প্রতিষ্ঠার আকুল আগ্রহে আজ আমাদের সমাজের বাহ্যিক অনুষ্ঠানগুলি আপনা হইতেই বিলীন হইতেছে, জাতিভেদ এবং ধর্মের কঠোর বিধি-নিষেধ আজ আর স্বজাতিবোধের পরিপন্থী নহে, শতধা বিচ্ছিন্ন শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি স্থাপনের প্রেরণায় ভারতের সর্বত্র আজ এক অপূর্ব আত্মসম্বিৎ চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে; আজি স্মরণ রাখিতে হইবে লোকোত্তর ঐক্যসাধক রামমোহনের অদম্য ব্যক্তিত্ব প্রভাবেই ভারতের পীেরুযশক্তি তাহার শৃঙ্খল মােচন করিতে পারিয়াছে ভারতের চিরন্তন মহাসত্যোপলব্ধির পথপ্রত্যেক মানুষের অন্তরশায়ী সর্বজাতির ঐক্যসাধক পরমপুরুষের অনুধ্যানে মনুষ্যমাত্রেরই সমানাধিকারের পথ রামমোহনই প্ৰস্তুত করিয়া গিয়াছেন। রামমােহনের যুগে সমগ্ৰ পৃথিবীতে একমাত্র তিনিই আধুনিক যুগের প্রকৃতাৰ্থ পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করিয়াছিলেন। তিনি জানিতেন বিচ্ছিন্ন সংকীর্ণ স্বাধীনতা মানবসাধনার উদ্দেশ্য নহে, বরং ব্যক্তিত্বের এবং রাষ্ট্রে সর্বজনীন পারস্পরিক নির্ভরতা সৌভ্রাত্রেই মানবসভ্যতার চরিতার্থতা। অপরিসীম গভীর জ্ঞান এবং সহজাত আত্মদৃষ্টি সহকারে তিনি মানবতার এই আদর্শ সমাজ ও সাহিত্যক্ষেত্র এবং ধর্মজগতে সঞ্চারিত করিয়াছিলেন, কদাপি বস্তুতান্ত্রিক গণ্ডিকে স্বীকার করেন নাই- কদাপি জাগতিক মোহের আকর্ষণে উদ্দেশ্যভ্রষ্ট হন নাই। ভারতের >br || > O