পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰবন্ধ S) (፩ S আমার মিলিয়াছিল। ইহার পূর্বে এত ঘনিষ্ঠভাবে তীহার সংস্পর্শে আসিবার অবসর আমার হয় নাই। তিনি নির্জনবাস হইতে যখন মাঝে মাঝে গৃহে আসিতেন, তখন আমি এবং পরিবারের অন্যান্য সকলেই তঁহাকে ভীতি ও শ্রদ্ধামিশ্রিত দৃষ্টিতে দেখিতাম। তিনি আমাকে তীহার সঙ্গে লইয়া যাওয়ার প্রস্তাব যখন করিলেন, তখন আমার যে আনন্দ হইয়াছিল তাহা বৰ্ণনা করা যায় না। হিমালয়ে যাইবার পথে আমরা কয়েকদিন শান্তিনিকেতনে ছিলাম। সেইখানেই তাহার নিকট আমার প্রথম শিক্ষা আরম্ভ হয়। ইহা ৬৫ বৎসর পূর্বের কথা। এখনকার মতো তখনও আমি লেখাপড়ায় উদাসীন ছিলাম। বর্তমানে যেখানে নাট্যঘর নির্মিত হইয়াছে, ওইখানে একটি নারিকেল গাছ ছিল। তাহার ছায়ায় বসিয়া আমি প্রথম কবিতার বই লিখি। আমার বালকোচিত খেয়ালে পিতা কখনো কোনো বাধা দিতেন না। কিন্তু অতি ঘনিষ্ঠভাবে তাহার সহিত মিশিবার সুযোগ পাইয়াও, এ কথা আমি সর্বদাই অনুভব করিতাম যে, তাহার আত্মা নক্ষত্রের মতো এক স্বতন্ত্র উধ্বলোকে বিরাজ করিত। আমি এখনকার মতো তখনও বুঝিতাম যে, তিনি যখন ধ্যানমগ্ন হইতেন, তখন তিনি নিজের ভিতরে ডুবিয়া যাইতেন, অস্তরের সহিত র্তাহার যোগ সংস্থাপিত হইত। হিমালয়ে যখন তিনি পূর্বাস্য হইয়া ধানে বসিতেন তখন স্বগীয় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত তাহার প্রশান্ত মুখমণ্ডল নিরীক্ষণ করিয়া আমার মনে যে ভীতি ও শ্রদ্ধার উদয় হইত, তাহা এখনও আমার স্মৃতিতে জাগরকে রহিয়াছে। যাহারা তঁহাকে জানিতেন ও শ্রদ্ধা করিতেন, তাহারা এই প্রশস্তি ও বৈরাগের মহিমা অনুভব করিয়াছেন। সৌর জগতে সূর্যের মতো তিনি তাহার আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে বিরাজ করিতেন। সকলের অতি নিকটে থাকিয়াও তিনি তুষারশীর্ষ কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো সকলের উর্ধের্ব মস্তক সমুন্নত রাখিতেন। এই আশ্রমই আমাদের নিকট তাহার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। বাহিরের কলকোলাহল হইতে দূরে অবস্থিত হইলেও মানুষের অন্তরতম কল্যাণ চিন্তা করা ইহার কাজ। শান্তিনিকেতন আশ্রমের পরিকল্পনা ও প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়া তাহার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবােধ ও জীবনের অন্তর্নিহিত সত্যোপলব্ধির পরিচয় পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে।মিথ্যা ভবিষ্যদবাণীর দ্বারা তিনি কখনাে কাহাকেও প্রতারিত করতেন না। কোনো অবস্থাতেই তিনি শাশ্বত আনন্দে তাঁহার যে অবিচল বিশ্বাস ছিল তাহা ক্ষুন্ন হইতে দিতেন না। তিনি জানিতেন যে, বন্ধন মুক্তি ব্যতীত আত্মোন্নতি সম্ভবপর নহে। তিনি এই আশ্রমের ভিতরে সেই মুক্তির ভাব সঞ্চারিত করিয়া গিয়াছেন। কৃত্রিম বন্ধনে সত্য যাহাতে শৃঙ্খলিত না হয় তজ্জন্য আমার যথাশক্তি চেষ্টা আমি করিয়াছি। আমারপিতারন্যায় আমিও বিশ্বাস করি যেস্বাধীনভাবে পরিবর্ধিত হইবার সুযোগ না পাইলে আত্মা বামন কখনাে চরমসার্থকতা লাভ করিতে পারেনা। আমি তঁহার নিকট আমার ঋণের কথা কখনাে বিস্মৃত হইতে পারি না। কারণ মানুষের ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা করিতে এবং সত্যকেসকলের উপরস্থান দিতে তিনিইতাহারাজীবনাদর্শদ্বারা আমাকে শিখাইয়াছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা শান্তিনিকেতন br TK So8 S ২০ জানুয়ারি ১৯৩৬ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ܓ . অদ্য সকলে ঘুম ভাঙিলে চাহিয়া দেখি পূর্বকােশ ঘন কৃষ্ণ মেঘে আচ্ছন্ন। মনে হইল আবহাওয়ার বিপর্যয়ে বুঝি আজিকার আনন্দের বাধা ঘটবে। তাহার পর চিন্তা আসিল, সত্যকার আনন্দ লাভ কত দুর্ঘট। এই প্ৰত্যহিক বাস্তবতার জগতে আনন্দের উৎস খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। আত্মার গভীরতর প্রদেশে ইহার স্থান। হয়তো ঈশ্বরেরই বিধান এই যে, সত্যকার আনন্দ পাইতে হইলে মানুষকে নিজেরই অন্তরে ইহার উৎস খুজিতে হইবে। è br | S S