পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S ( N রবীন্দ্র-রচনাবলী মানুষ এই জগতে বহু অক্ষমতা লইয়া আসিয়াছে। দুর্ভাগ্যক্রমে আজ জগতের আর আর প্রাণীর মতো হিংস্রতা ও জড়তার মাত্রা তাহারও মধ্যে পুরোপুরিই রহিয়াছে। এই দুর্লঙ্ঘ্য বাধা অতিক্রম করিয়া, আত্মার স্বভাবসিদ্ধ অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ সাধন করাই মানুষের জীবনের ব্ৰত বলিয়া বোধ হয়। আমি মনে করি, আজিকার আকাশপটে উজ্জ্বল অক্ষরে এই সত্যই লিখিত রহিয়াছে। মানুষকে এই অন্ধকারের যবনিক ছিড়িয়া ফেলিতে হইবে এবং তাহার হৃদয়ের গভীর প্রদেশে যে জীবন ও আলোক নির্বাের রহিয়াছে, তাহা আবিষ্কার করিতে হইবে। আজ আমার পূজনীয় পিতৃদেবের কথা মনে পড়িতেছে- সারা জীবন ধরিয়া ঐকাস্তিক তীব্রতা-সহকারে তিনি এই অন্ধকার ও মৃত্যুকে জয় করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। এই জগতের অপূর্ণত হইতে মুক্তিলাভ করিবার জন্য তিনি অমৃতের অনুসন্ধান করিয়াছেন। র্তাহার বিপুল পার্থিব সম্পদ তাহাকে বধিয়া রাখিতে পারে নাই। বিলাসিত ও স্বাচ্ছন্দ্য র্তাহাকে আত্মপ্রসাদ ও আরামের অভিশপ্ত জীবনের মধ্যে বদ্ধ করে নাই। জীবনের এই বৃহত্তর লক্ষ্যের অনুসন্ধানে রত ছিলেন বলিয়াই যেদিন দারিদ্র্যের রূঢ় আঘাত ভূমিকম্পের আকস্মিকতার মতো তঁহার উপর আসিয়া পড়িল, তখন তাহা তিনি সহা করিতে পারিয়াছিলেন। সর্বোপরি তাঁহার ছিল সেই আধ্যাত্মিক নিরাসক্তি বাহা ঘটনায় যাহা এতটুকুও বিচলিত হইত না। ঐশ্বর্যের গুরুভারমুক্ত র্তাহার হৃদয় ত্যাগের আনন্দ উপলব্ধি করিয়াছে; কিন্তু তাই বলিয়া তিনি পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের বিবিধ কর্মের দায়িত্ব এড়াইতে চাহেন নাই। কৰ্ম্মণ্যবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন” গীতায় উপদিষ্ট এই সত্য তিনি নিজ জীবনে পালন করিয়া গিয়াছেন। নাবিকের মতন তিনি জীবনের বােঝাই তরী সংকট-সংকুল সমুদ্রের দুঃখকষ্ট ও পরীক্ষার মধ্য দিয়া চালাইয়া লইয়া গিয়াছেন। জীবনযুদ্ধের কর্মব্যস্ততার মধ্যেও পরিপূর্ণভাবে বিবিক্তি থাকিতে হইবে- পিতৃদেবের উদাহরণ হইতে এই শিক্ষাই আমি লাভ করিয়াছি এবং দৃঢ়তাসহকারে এই কথা বলিতে পারি যে, এই প্রতিষ্ঠান গঠনে যে চল্লিশ বৎসর ব্যয়িত হইয়াছে, তাহাতে এই শিক্ষা আমার বিশেষ কাজে আসিয়াছে। এই সময়ে আমি বহু ও বিবিধ দূর্ভাগ্যের আঘাতে জর্জরিত ও নিরাশ হইয়াছি, বহুবার ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছি। বহু দুঃখ ভোগ করিয়াছি। উদাসীন জনসাধারণের হৃদয়হীন অবহেলা সহ্য করিয়াছি। এই প্রতিকূলতার দিনে আমার পিতৃদেবের মহান ভােব আমাকে পথ দেখাইয়াছে। ইহাকে আমি আমার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠতম সম্পদ বলিয়া বিবেচনা করি। বহু বাধা, বিপদ সত্ত্বেও আমার জীবনের দীর্ঘদিন ধরিয়া আমি এই আশ্রমটি গড়িতে চেষ্টা করিয়াছি- কোনো পার্থিব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নহে। এই আশ্রমে এবং আশ্রমের মধ্য দিয়া আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আদর্শকে উপলব্ধি করিবার দৃঢ় ইচ্ছার বশে এই চেষ্টা করিয়াছি। যাহারা স্বাৰ্থ খোজে, যাহারা আত্ম-প্রচারের অভিলাষী, এই স্থান তাহাদের জন্য নয়। যাহারা প্রেম ও ভ্রাতৃত্বের সংস্কৃতিগত সংযোগের মধ্য দিয়ে মানুষের অজ্ঞলোকের পুনরুজীবন চায়, এই স্থান তাহাদেরই মিলন-ভূমি। আজিকার উৎসব দিনের ইহাই বাণী। আনন্দবাজার পত্রিকা ठे (श्रेष S७8७ মুসী প্রেমচাঁদ সাহিত্যিক হিসাবে প্ৰেমচান্দজীর খ্যাতি কেবলমাত্র প্রদেশ মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তাঁহার মৃত্যুতে আজ আমরাও অভাব বােধ করিতেছি। শান্তিনিকেতন ১৫ অক্টোবর ১৯৩৬ ৩০ আশ্বিন ১৩৪৩ ৷