পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ প্ৰথম অঙ্ক বিপ্রদাস। কুমু, জানলার কাছে সমস্ত সকাল একলা বসে কী করছিস, বোেন? মানিকতলার তেলকলের বাঁশি শুনছিস? আর দেখছিস ওই রাস্তার ধারে জলের কলের কাছে হিন্দুস্থানী মেয়ের সঙ্গে উড়ে বামুনের ঝগড়া! কুমুদিনী। দাদা, আমি ভাবছি। কলকাতাটা কী ভয়ানক বড়ো, আর আমি তার এক কোণে কতই ছোটো! বিপ্ৰদাস। কলকাতা যে অচেনা, তাই তো এর বড়োর বড়াই রে। ওকে হৃদয় দিয়ে ঘিরে নিতে পারিনি রে বােন, পারি নে। আর আমাদের সেই নুরনগরের পৈতৃক ভিটে, সে এর চেয়ে কত ছোটাে কিন্তু কত বড়ো। সেই যে পুব আকাশের দিগন্তে ঘন বন, সেই যে ধানের খেত পেরিয়ে বালুর চর, চর পেরিয়ে নীল জলের রেখা, কাশবন, বন-ঝাউয়ের ঝোপ, গুণ টানার পথ, জেলের নীেকোর খয়েরি রঙের পাল, বাঁশঝাড়ের মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে গোপীনাথজির মন্দির-চূড়ো, সে আমাদের নীল-আকাশ-ভরা শ্যামল নুরনগর, সে কত বড়ো কিন্তু কত আপন। কুমুদিনী। কচি ছেলের কাছে মা যত বড়ো সে আমাদের ততই বড়ো, তবুও সে নিতান্ত সহজ। আমাদের কাছে, নিতান্ত আপনার। বিপ্রদাস। আর এই কলকাতাটা কোন দৈত্য-ইস্কুলের ক্লাসে ময়লা আকাশের বাের্ডের উপর জিয়োমেট্রির খোচা-ওয়ালা আঁক-কাটা প্রব্রেম। কিন্তু ভয় করলে চলবে না কুমু। কুমুদিনী। করব না ভয়। বিপ্ৰদাস। এই শক্ত প্ৰব্লেম নিয়েই পরীক্ষা পাস করতে হবে। কুমুদিনী। নিশ্চয় পাস করব তোমার আশীর্বাদে। শক্তকেই জোরের সঙ্গে মেনে নেব। তুমি यशद्ध उीका (उदां नां प्रॉनों | বিপ্রদাস। কী জানিস, আমাদের বাপ-দাদার ছিল সেকেলে নবাবি চাল। আতসবাজির মতো সেদিনকার ঐশ্বর্যের ঝলক তঁরা শূন্যে মিলিয়ে শেষ করে দিয়ে গেছেন। আমাদের জন্যে রেখে গেলেন পোড়া ঐশ্বর্যের ঋণের অঙ্গার। ওইটে সাফ করে যেতে হবে। ভালোই হয়েছে, কুমু, সেকালের বাবুগিরির নোংরা উচ্ছিষ্ট ভোগ করতে আমরা আসি নি। কী বলিস কুমু? কুমুদিনী। হাঁ দাদা, ভালোই হয়েছে। বিপ্ৰদাস। আমরা সহ্য করতে জয় করতে এসেছি। ভোগ করতে আসি নি। সেই দেউলে সেকাল, সেই ভূতে পাওয়া হানাবাড়ি, তার চেয়ে অনেক ভালো এই পাষাণী কলকাতার নীরস অনাদর। কুমুদিনী। ভালো, ভালো, ঢের ভালো। দাদা, তুমি ভাবছ আমাদের চিরদিনের ভিটে ছেড়ে এসে আমি কষ্ট পাচ্ছি- তাই মাঝে মাঝে আমাকে সাহস দিতে চাও! কিন্তু কষ্ট পেলেই বা কী!! আমার ঠাকুর আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন, তিনি আমাকে ভুলতে দেবেন না বলেই। আমি ঐশ্বর্যের কঙাল নই। আমি চাই তাকেই, আমার প্রাণের ঠাকুরকে। কিন্তু দাদা, আমাকে একটি কথা দিতে হবে। বিপ্রদাস। কী বল কুমু। কুমুদিনী। তুমি যখন কোনাে দুঃখ পাবে আমার কাছে লুকোতে পারবে না। তোমার দুঃখের ভাগ নেব আমি; ঐশ্বর্যের ভাগ নাই-বা রইল! বিপ্ৰদাস। আচ্ছা, তাই হবে।