পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

R ( 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী মুখের দিকে, আমার রক্তচলাচল গেল থেমে। গভীর সুরে বললেন, “সুষম আমার ছাত্রী, তার ভার আমার উপরে, তা ছাড়া আমার ভার তোমার উপরে নেই।” পুরুষের কাছে এত বড়ো ধাক্কা আমার জীবনে এই প্রথম। ধারণা ছিল সব পুরুষের পরেই সব মেয়ের আবদার চলে যদি সাহস থাকে আবদার করবার। দেখলেম দুর্ভেদ্য দুর্গ আছে, মেয়েদের সাংঘাতিক বিপদ সেই রুদ্ধদ্বারের সামনে। এর পরের অধ্যায়ের বিবরণ পাওয়া যায় একখানা চিঠি থেকে, তার কপি দেখাব তোমার শিক্ষার্থে।” এমন সময়ে যে-ঘরে সভা বসেছিল সেখানে কোন এক জানলা থেকে অপরাহু-সূর্যের রশ্মি বঁকা হয়ে পড়ল ঠিক সুষমার মুখে। দূর থেকে বাঁশরি দেখতে পেলে উপদেশের এক অংশে মুক্তারাম বর-কনের পরস্পরের আঙটিবদল উপলক্ষে সুষমার আঙুল থেকে আঙটি খুলে নিয়ে সোেমশংকরের আঙুলে পরাচ্ছে। সুষমা পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ, শান্ত তার মুখ, দুই চােখ দিয়ে ঝরঝর করে] পড়ছে জল। বাঁশরি বললে, “মুক্তারামের মুখখানা একবার দেখো। ওই যে সূর্যের আলো এসে পড়েছে তার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যেমন লক্ষ যোজন মাইল দূরে, ওই মেয়েটার মনে যে অগ্নিকাণ্ড চলছে তার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। অথচ তাকে নিয়ে উজ্জ্বল ছবি বানিয়ে তুললে, মুক্তরামও নিজের মধ্যে যে তত্ত্বটা নিয়ে আছে সে ওই মেয়েটার মর্মান্তিক বেদনা থেকে বহুদূরে, তবু নিষ্ঠুর রেখায় ফুটিয়ে তুললে নাটকটাকে।” পৃথীশ জিজ্ঞাসা করলে, “সুষমার প্রতি সন্ন্যাসীর মন সত্যিই এতই যদি নির্লিপ্ত হবে ওকে । আমন করে বেছে নিলে কেন?” “আইডিয়ালিস্ট! বাস রে ওদের মতো ভয়ংকর নির্মম জীব নেই জগতে। আফ্রিকার অসভ্য মারে মানুষকে নিজে খাবে বলে। এরা মারে তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায়, নিজে খায় না। ক্ষিধে পেলেও, সারে সারে নরবলি দেয় আইডিয়ার কাছে। জেঙ্গিস খাঁর চেয়ে সর্বনেশো।” “বাঁশি, সন্ন্যাসীর 'পরে তোমার মনোভাবে কোনো রস দেখছি না তো। করুণা নয়, ভক্তি তো নয়ই।” ‘ভক্তি করবার মেয়ে নাই গো আমি! মেয়েদের পরমশত্রু ওই মানুষটা। রাজারানী যদি হতুম দেয় ফেলে ওর কোন এক জগন্নাথের রথের তলায়, বুকের পাঁজর যায় গুড়িয়ে।” “ওর আইডিয়াটা কী জানা চাই তো।” “সন্ধান পাওয়া শক্ত। ওর এক শিষ্যকে জানি, তার রস সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায় নি, ডাক দিলে খুশি হয়ে আসে কাছে। সেই মুগ্ধের মুখ থেকে খবর আদায় করেছিলুম। তরুণ তাপস সংঘ’ নামে মুক্তারাম এক সংঘ বানিয়েছে। বাছা বাছা ছেলেদের পুরোপুরি মানুষ করে তোেলবার ব্ৰত ওর। তার পরে বীজ বপনের নিয়মে সমস্ত ভারতবৰ্যময় দেবে তাদের ছড়িয়ে।” “কিন্তু তরুণী ?” “একেবারে বিবর্জিতা।” . “অন্ন চাই যে। ব্ৰহ্মচারীকেও ভিক্ষার জন্য আসতে হয় মেয়েদের দ্বারে। রাজভাণ্ডারের চাবি ছুটি গুর হতে। রেসে অনুষ্ঠােটা শেষ হয় আসছে এইবার একবার ধরে ঢুকে দোষ (5' গেল। ঘরের মধ্যে। তখন মুক্তারাম বলছে, “তোমরা যে সম্বন্ধ স্বীকার করছ, জেনো, সে আত্মপ্রকাশের জন্যে, আত্মবিলোপের জন্যে নয়। যে-সম্বন্ধ মুক্তির দিকে নিয়ে চলে তাকেই শ্রদ্ধা করি, যা বেঁধে রাখে পশুর মতো তা প্রকৃতির হাতে গড়া প্রবৃত্তির শিকলই হােক আর মানুষের কারখানায় গড়া দাসত্বের শিকলই হােক- ধিক তাকে।”