পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

R(\t রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী না। কী বলব, বিধাতা শক্তি দেন নি। নইলে এমন কিছু বলতুম যার অক্ষরে অক্ষরে উঠত আগুনের ফোয়ারা। আর্টিস্টের মতো দেখতে পাচ্ছি। সমস্তটাই স্পষ্ট, অথচ আর্টিস্টের মতো বলতে পারছি না। স্পষ্ট করে। চতুর্মুখ যদি বােবা হতেন তা হলে অসৃষ্ট বিশ্বের ব্যথায় মহাকাশের “বাঁশি, কে বলে তুমি প্রকাশ করতে পাের না? কে বলে তুমি নও পুরো আর্টস্ট? তোমার দুঃস্থ হল দুখ যুথ যেখান সেখােন বির গুলি হতে হাঁড়ার ফেলে যে আমার श्श।” ‘আমি যে মেয়ে, আমার প্রকাশ ব্যক্তিগত। বলবার লোক স্পষ্ট সামনে পেলে তবেই বলতে পারি। কেউ নেই। অথচ বলা আছে এইটে পুরুষ আর্টিস্টের। সেই বলা চিরকালের- আমাদের বলা যত ভালোই হােক সে কেবল নগদ বিদায় দিনেদিনের। ঘরে ঘরে মুহূর্তে মুহুর্তে সে বুদবুদের মতো উঠছে আর মেলাচ্ছে।” পুরুষ আটিস্টের অহংকার ঘনিয়ে উঠল, সে বললে, “আচ্ছা বেশ, কাজ শুরু হােক। কাল বলেছিলে একটা চিঠির কথা।” “এই নাও”, বলে একটা চিঠির কপি করা এক অংশ ওকে পড়তে দিলে। তাতে । আছে—“প্রেমে মানুষের মুক্তি। কবিরা যাকে ভালোবাসা বলে সেটা বন্ধন। তাতে একজন মানুষকে আসক্তির দ্বারা বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে তাকেই তীব্র স্বাতন্ত্রে অতিকৃত করে তোলে। যত তার দাম প্রকৃতিজুয়ারি তার চেয়ে অনেক বেশি ঠকিয়ে আদায় করে। এই তো প্রকৃতির চাতুরি, নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে। মোহের জাদু লাগিয়ে এই মরীচিকার সৃষ্টি। এই কথাটাকেই শেক্সপিয়ার কীেতুকচ্ছলে দেখিয়েছেন তীর ভরাবসন্তের স্বপ্নে। প্রেম জাগ্ৰত দৃষ্টি, নরনারীর ভালোবাসা স্বপ্নদৃষ্টি নেশার ঘোরে। প্রকৃতি মদ ঢেলে দেয় দেহের পাত্রে, তাতে যে অনুভূতিকে তীব্র করে, তাকে সহজ সত্যবােধের চেয়ে বেশি সত্য বলে ভুল হয়। এই ভোলানােটা প্রকৃতির স্বরচিত। খাচাকেও পাখি ভালোবাসে যদি তাকে আফিমের নেশায় বশ করা যায়। বন্ধনের প্রতি আসক্তিকে সর্বাস্তঃকরণে ভয় করো, জেনো ওটা সত্য নয়। সংসারে যত দুঃখ, যত বিরোধ সকলের মূল এই ভ্রান্তি নিয়ে, যে ভ্রান্তি শিকলকে মূল্যবান করে দেখায়। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে যদি চিনতে চাও, তবে বিচার করলেই বুঝতে পারবে কোনটাতে মুক্তি দেয়, কোনটাতে দেয় না। প্রেমে মুক্তি, আসক্তিতে বন্ধন।” “চিঠি পড়লুম। তার পরে?” “তারপরে তোমার মাথা, অর্থাৎ কল্পনা। মনে মনে শুনতে পােচ্ছ না, শিষ্যকে বলছেন সন্ন্যাসী-ভালোবাসা আমাকেও না, ভালোবাসা আর কাউকেও না। নির্বিশেষ প্ৰেম, নির্বিকার আনন্দ, নিরাপদ আত্মনিবেদন, এই হল দীক্ষামন্ত্র।” “তা হলে এর মধ্যে সোমশংকর আসে কোথা থেকে?” । সেই রাস্তাই তো তৈরি হল প্রেমে। সন্ন্যাসী বলেছেন প্রেমে সকলেরই অধিকার। সোমশংকরের তাতে পেট ভরবে না, সে চেয়েছিল বিশেষ প্ৰেম, মীনলাঞ্ছনের মার্কা মারা। কিন্তু সর্বনাশে সমুৎপন্ন যথালাভ, অর্ধেকের চেয়ে কম হলেও চলে। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, সুষম ওকে নিশ্চয় খুব গভীর সুরে বলেছিল, যে-প্ৰেম বিশ্বের সকলের জন্যে আমাদের দুজনের মিলন সেই প্রোেমর পথকেই খুলে দেবে। পথের মাঝখানটা ঘিরে নিয়ে দেয়াল তুলবে না। শুনে সোেমশংকরের ভালোবাসা দ্বিগুণ প্রবল হয়েছে। সেই ভালোবাসা নির্বিশেষ প্রেম নয়। এ কথা লিখে রাখতে পারে।” । “আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, এ অবস্থায় তুমি হলে কী করতে।” । “আমি হলে পরম ভক্তিভারে সন্ন্যাসীর কথা সোনার জলে মরক্কো চামড়ার বাঁধা খাতায় লিখে রাখতুম, তার পরে দুৰ্গম আসক্তির জোর কলমে তার প্রত্যেক অক্ষরের উপর দিতাম কালির আঁচড় কোিট। ওই তাপস চায় প্রকৃতির মতোই মুগ্ধ করতে, নিজের মন্ত্র দিয়ে অন্যের