পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܔ 8 (একসপ্ততিতম সাম্বাৎসরিক মাঘোৎসবে পঠিত) ভারতসম্রাজ্ঞী মহারানী ভিক্টেরিয়া— যিনি সুদীর্ঘকাল তঁহার বিপুল সাম্রাজ্যের জননীপদে অধিষ্ঠিতা ছিলেন, যিনি তাহার রাজশক্তিকে মাতৃস্নেহের দ্বারা সুধাসিক্ত করিয়া আঁহার অগণ্য প্রজাবৃন্দের নত মস্তকের উপরে প্রসারিত করিয়া রাখিয়াছিলেন, ক্ষমা শান্তি এবং কল্যাণ যাহার। অকলঙ্ক রাজদণ্ডকে পরিবেষ্টন করিয়াছিল, সেই ভারতেশ্বরী মহারানী যে পরম পুরুষের নিয়োগে এই পার্থিব রাজ্যভার গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং যাহার প্রসাদে সুচিরকাল জীবিত থাকিয়া আনন্দিতা রাজশ্ৰীকে দেশে কালে এবং প্রকৃতিবর্গের হৃদয়ের মধ্যে সুদৃঢ়তররূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, আদ্য সমস্ত রাজসম্পদ পরিহারপূর্বক ললাটের মাণিক্যমণ্ডিত মুকুট অবতারণ করিয়া মৃত্যু প্রতিদিন এই সংসারে যাতায়াত করিতেছে কিন্তু আমরা তাহার গোপন পদসঞ্চার লক্ষা করি না। সেই মৃত্যু যখন রাজসিংহাসনের উপরেও অবহেলাভরে আপনি অমোঘ কর প্রসারণ করে তখন মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুর বিরাট স্বরূপ কোটি কোটি লোকের নিকট পূর্ণসূৰ্যগ্রহণের রাহুচ্ছায়ার ন্যায় দৃষ্টিগােচর হয়। অদ্য সমস্ত পৃথিবীর উপরে এই মৃত্যুর স্বরূপ প্রকাশিত হইয়াছে। সাধারণ লোকের কুটিরপ্রাঙ্গণে যাহার গতিবিধি লক্ষ্যপথে পড়ে না, সে আজ অভ্ৰভেদী রাজসিংহাসনের উপরে দণ্ডায়মান হইয়া আপনাকে সর্বসমক্ষে প্রচার কবিয়াছে। কিন্তু আমরা আতঙ্কে তাহার নিকট মস্তক অবনত করিব না। ত্রাসের এবং শোকের সমস্ত অন্ধকারপুঞ্জ অপসারণ করিয়া আমরা তঁহাকেই স্মরণ করিব, যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যুঃ- যাহার ছায়া অমৃত যাহার ছায়া মৃত্যু। যতো বা ইমানি ভূতানি জায়স্তে যেন জাতানি জীবস্তি যং প্রয়স্তাভিসংবিশন্তি তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব! যাহা হইতে এই ভূত সকল উৎপন্ন হয় যাহার দ্বারা জীবিত রহে এবং যাহার মধ্যে প্রবেশ করে, অদ্য পৃথিবীব্যাপী মৃত্যুশোকের মধ্যে তঁহাকেই বিশেষরূপে জানিতে ইচ্ছা! করে। কত চন্দ্ৰসূৰ্য গ্ৰহতারকা তাহার জ্যোতিঃকণায় প্ৰজ্বলিত ও চরণাচ্ছায়ায় নির্বাপিত হইয়াছে, পৃথিবীর কোন মৃত্যু কোন মহৎ শোক তাহার মহােৎসবকে কণামাত্র আচ্ছন্ন করিতে পারে % হে শোকার্ত, হে মরণভয়াতুর, অদ্য তাহাকেই বিশেষরূপে জানিতে ইচ্ছা করে। আনন্দাদ্ধোব খদ্বিমানি ভুতানি জায়ন্তে আনন্দেন জাতানি জীবস্তি, আনন্দং প্রয়স্তাভিসংবিশন্তি-- তিনি পরমানন্দ- সেই আনন্দ হইতেই এই ভূত সকল উৎপন্ন হইতেছে সেই আনন্দের দ্বারাই জীবিত রহিতেছে এবং ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্ৰজা, পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গ, সচেতন-অচেতন যাহা-কিছু অহরহ তাহার প্রতি গমন করিতেছে এবং তঁহার মধ্যেই প্রবেশ করিতেছে। পৃথিবীর অতীতকালের রাজাধিরাজগণ অদ্য কোথায়! কোথায় দিগবিজয়ী রঘু, কোথায় আসমূদ্র ক্ষিতীশ ভরত-– যদুপাতেঃ কি গতা মথুরাপুরী, রঘুপতেঃ ক গতোত্তর কোশলা! পৃথিবীর সুবৃহৎ রাজমহিমা মুহূর্তে মুহূর্তে যাহার জ্যোতিঃসাগরে বুদবুদের ন্যায় বিলীন হইতেছে অদ্য আমরা তাহার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়াছি। এই কথা আমাদিগকে স্মরণ করিতে হইবে: সেখানে ন জরা ন মৃত্যুর্ন শোকঃ! অদ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীশ্বরী তাহার দীর্ঘজীবনের সমস্ত কৃতকর্ম যাহার পদতলে সমৰ্পণ করিয়া করজোড়ে মুকুটবিহীন মস্তক অবনত করিয়াছেন--- আমরাও অদ্য সেই বিশ্বভুবনেশ্বরের সম্মুখে আমাদের সমস্ত পাপ-তাপ-শোক আমাদের ভক্তিপ্রতি-পূজা স্থাপন করিয়া নতশিরে দণ্ডায়মান হইয়াছি, তিনি আমাদিগকে বিচার করুন, আমাদের মঙ্গল বিধান করুন, আমাদের এই পার্থিব জীবনকে সার্থকতা দান করিয়া নৃত্যুর পরে পরিপূর্ণতর জীবনের মধ্যে তঁহার অমৃতবক্ষে আমাদিগকে আহবান করিয়া লউন! ভারতী, ফাল্লুন, ১৩০৭ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ফাঙ্গুন ১৩০৭