পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(? ど রবীন্দ্র-রচনাবলী পরিণামের জন্য সে অপেক্ষা করিতেছে, বিধাতা তাহার সম্মুখে কী সমস্যা আনিয়া উপস্থিত করিয়াছেন, এই কথা লইয়া কতদিন গোধূলির ধূসর আলোকে বােলপুরের শস্যহীন জনশূন্য প্রাস্তরের প্রাস্তবতী রক্তবর্ণ সুদীর্ঘ পথের উপর দিয়া আমরা দুইজনে পদচারণ করিয়াছি। আমি এই-সকল নানা কথা ভাবের দিক দিয়াই ভাবিয়াছি; আমি পণ্ডিত নহি, বিচিত্র মানবসংসারের বৃত্তান্ত সম্বন্ধে আমি অনভিজ্ঞ। কিন্তু রাজপথ যেমন সকল যাত্রারই যাতায়াত অনায়াসে সহ) করে, সেইরূপ মোহিত চন্দ্রের যুক্তিশাস্ত্ৰে সুপরিণত সর্বসহিষ্ণু পাণ্ডিত্য আমার নিঃসহায় ভাবগুলির গতিবিধিকে অকালে তর্কের দ্বারা রোধ করিত না— তাহারা কোন পর্যন্ত গিয়া পৌঁছে, তাহা অবধািনপূর্বক লক্ষা করিতে চেষ্টা করিত। যুক্তি-নামক সংহত-আলোকের লণ্ঠন এবং কল্পনা-নামক জ্যোতিন্ধের ব্যাপকদীপ্তি, দুই তিনি ব্যবহারে লাগাইতেন; সেইজনা অন্যে যাহা বলিত, নিজের মধ্য হইতে তাহা পূরণ করিয়া লইবার শক্তি র্তাহার ছিল; সেইজনা পণ্ডিত্যের কঠিন বেষ্টনে তাহার মন সংকীর্ণ ছিল না, কল্পনাযোগে সর্বত্র তাহার সহজ যাঁহাদের আছে, তাহারা প্রথম উদযোগের অনিবার্য ছােটােখাটাে ক্রটিকে সংকীর্ণ অধৈৰ্যদ্বারা বড়ো করিয়া তুলিয়া সমগ্রকে বিকৃত করিয়া দেখেন না। আমার নূতনস্থাপিত বিদ্যালয়ের সমস্ত দুর্বলতা-বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করিয়া মোহিতচন্দ্ৰ ইহার অনতিগোচর সম্পূর্ণতাকে উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন। তখন আমার পক্ষে এমন সহায়তা আর কিছুই হইতে পারিত না। যাহা আমার প্ৰয়াসের মধ্যে আছে, তাহা আর-একজনের উপলব্ধির নিকট সত্য হইয়া উঠিয়াছে, উদযোগকর্তার পক্ষে এমন বল— এমন আনন্দ আর কিছুই হইতে পারে না। বিশেষত তখন কেবল আমার দুই-একজন-মাত্র সহায়কারী সুহৃৎ ছিলেন; তখন অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা এবং বিঘ্নে আমার এই কর্মের ভার আমার পক্ষে অত্যন্ত দূর্বাহ হইয়া উঠিয়াছিল। একদিন কলিকাতা হইতে চিঠি পাইলাম, আমার কাছে তাহার একটু বিশেষ প্রয়োজন আছে, তিনি বােলপুরে আসিতে চান। সন্ধার গাড়িতে আসিলেন। আহারে বসিবার পূর্বে আমাকে কোণে ডাকিয়া লইয়া কাজের কথাটা শেষ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। নিভৃতে আসিয়া কুষ্ঠিতভাবে কহিলেন– “আমি মনে করিয়াছিলাম, এবারে পরীক্ষকের পারিশ্রমিক যাহা পাইব, তাহা নিজে রাখিব না। এই বিদ্যালয়ে আমি নিজে যখন খাটিবার সুযোগ পাইতেছি না, তখন আমার সাধ্যমতো কিছু দান করিয়া আমি তৃপ্তিলাভ করিতে ইচ্ছা করি।” এই বলিয়া সলজ্জভাবে আমার হাতে একখানি নোট গুজিয়া দিলেন। নোিট খুলিয়া দেখিলাম, হাজার টাকা। এই হাজার টাকার মতো দুর্লভ দুমূল্য হাজার টাকা ইহার পূর্বে এবং পরে আমার হাতে আর পড়ে নাই। টাকায় যাহা পাওয়া যায় না, এই হাজার টাকায় তাহ পাইলাম। আমার সমস্ত বিদ্যালয় একটা নূতন শক্তির আনন্দে সজীব হইয়া উঠিল। বিশ্বের মঙ্গলশক্তি যে কীরূপ অভাবনীয়রূপে কাজ করে, তাহা এমনিই আমাদের কাছে প্ৰত্যক্ষ হইল যে, আমাদের মাথার উপর হইতে বিষ্মবাধার ভার লঘু হইয়া গেল। ঠিক তাহার পরেই পারিবারিক সংকটে আমাকে দীর্ঘকাল প্রবাসে যাপন করিতে বাধ্য হইতে হইয়াছিল এবং যে আত্নীয়ের উপর নির্ভর করিবার প্রয়োজন ছিল, সে এমনি অকারণে বিমুখ হইল যে, সেই সময়ের আঘাত আমার পক্ষে একেবারে অসহ্য হইতে পারিত। এমন সময় নোটের আকারে মোহিতচন্দ্র যখন অকস্মাৎ কল্যাণবর্ষণ করিলেন, তখন স্পষ্টই বুঝিতে পরিলাম যে, আমিই যে কেবল আমার সংকল্পটুকুকে লইয়া জাগিব।ার চেষ্টা করিতেছি, তাহা নহে— মঙ্গল জাগিয়া আছে। আমার দুর্বলতা, আমার আশঙ্কা, সমস্ত চলিয়া গেল। ইহার কিছুকাল পরে মোহিতচন্দ্ৰ বােলপুর-বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষপদ গ্রহণ করিয়াছিলেন, কিন্তু কঠিনপীড়াগ্রস্ত হইয়া ডাক্তারের পরামর্শক্রমে ইহাকে পুনরায় কলিকাতায় আশ্রয়গ্ৰহণ করিতে হইল। "