পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

क्ष a○ মৃত্যু তার পক্ষেই অত্যন্ত ফাঁকি। আমিকে জীবনে যে অত্যন্ত বড়ো করে নি। সেই তো মৃত্যুকে সার্থক করে জানে। সাহিত্যে চিত্রকলায় ব্যঞ্জনাই রসের প্রধান আধার। এই ব্যঞ্জনার মানে, কথাকে বিরল করে ফাকের ভিতর দিয়ে ভাবের ধারা বইয়ে দেওয়া। বাক্য ও অলংকারের বিরলতার ভিতর দিয়ে রসে পূর্ণরূপে প্রকাশ পায় তঁরাই রসজ্ঞ। ভাবের মহলে যারা অর্বাচীন তারা উপকরণকেই বড়ো করে দেখে সীতাকে নয়। সুতরাং উপকরণের ফাঁক তাদের কাছে সম্পূর্ণই ফঁােক। তেমনি নিজের আয়ুকালটাকে যে মানুষ “আমি” ও “আমি’র আয়োজন দিয়েই ঠেসে ভরিয়ে দেয়, সেই মানুষের মধ্যে অসীমের ব্যঞ্জনা থাকে না— সেইজন্যে মৃত্যু তার পক্ষে একান্ত মৃত্যু। দিনের বেলাটা কর্ম দিয়ে, খেলা দিয়ে ভরাট থাকে। রাত্রি যখন আসে, শিশু তখন ভয় পায়, কঁদে। প্রত্যক্ষ তার কাছে আচ্ছন্ন হয়ে যায় বলে সে মনে করে সবই বুঝি গেল। কিন্তু আমরা জানি, ছেদ ঘটে না, রাত্রি ধাত্রীর মতো দিনকে অঞ্চলের আবরণের মধ্যে পালন করে। রাত্রিতে অন্ধকারের কালো ফাকটা যদি না থাকত তা হলে নক্ষত্ৰলোকের জ্যোতির্ময় ব্যঞ্জনা পেতুম কেমন করে? সেই নক্ষত্র আমাদের বলছে, “তোমরা পৃথিবী তো এক ফোটা মাটি, দিনের বেলায় তঁকেই তোমার সর্বস্ব জেনে আঁকড়ে পড়ে আছ। অন্ধকারে আমাদের দিকে চেয়ে দেখোআমরাও তোমার। আমাদের নিয়ে আর তোমাকে নিয়ে এক হয়ে আছে এই বিশ্ব, এইটেই সত্য।’ অন্ধকারের মধ্যে নিখিলবিশ্বের ব্যঞ্জনা যেমন, মৃত্যুর মধ্যেও পরম প্রাণের ব্যঞ্জনা তেমনি। আমার ফাক মানব না। ফাককে মানাই নাস্তিকতা। চোখে যেখানে ফ্যাক দেখি আমাদের অন্তরাত্মা সেইখানে যেন পূর্ণকে দেখে। আমার মধ্যে এবং অন্যের মধ্যে মানুষে মানুষে তো আকাশগত ফাক আছে; যে লোক সেই ফাকটাকেই অত্যন্ত বেশি করে সত্য জানে সেই হল স্বার্থপর সেই হল অহংনিষ্ঠ। সে বলে, ও আলাদা, আমি আলাদা। মহাত্মা কাকে বলি যিনি সেই ফাককে আত্মীয়সম্বন্ধের দ্বারা পূৰ্ণ করে জানেন, জ্যোতির্বিৎ যেমন করে জানেন যে, পৃথিবী ও চন্দ্রের মাঝখানকার শূন্য পরস্পরের আত্মীয়তার আকর্ষণসূত্র বহন করছে। এক দেশের মানুষের সঙ্গে আর-এক দেশের মানুষের ফাক আরো বড়ো। শুধু আকাশের ফাক নয়, আচারের ফাক, ভাষার ফাক, ইতিহাসের ফাক। এই ফাককে যারা পূৰ্ণ করে দেখতে পারলে না তারা পরস্পর লড়াই করে পরস্পরকে প্রতারণা করে মরছে। তারা প্রত্যেকেই 'আমরা বড়ো” আমরা স্বতন্ত্র এই কথা গর্ব করে জয়ডঙ্কা বাজিয়ে ঘোষণা করে বেড়াচ্ছে। অন্ধ যদি বুক ফুলিয়ে বলে, “আমি ছাড়া বিশ্বে আর কিছুই নেই। সে যেমন হয় এও তেমনি। আমাদের ঋষিরা বলেছেন, পরকে যে আত্মবৎ দেখেছে সেই সত্যকে দেখেছে। কেবল কুটুম্বকে, কেবল দেশের মানুষকে আত্মবৎ দেখা নয়, মহাপুরুষেরা বলেছেন শত্রুকেও আত্মবৎ দেখতে হবে। এই সত্যকে আমি আয়ত্ত করতে পারি নি বলে একে অসত্য বলে উপহাস করতে পারব না, একে আমার সাধনার মধ্যে গ্রহণ করতে হবে। কেননা পূৰ্ণস্বরূপের বিশ্বে আমরা ফাক মানতে পারব না। এই কথাটি আজ এত জোরের সঙ্গে আমার মনে বেজে উঠেছে তার কারণ সেদিন সেই যুবকের মৃত্যুশয্যায় দেখলুম সুদীর্ঘকাল দুঃখভোগের পরে জীবনের প্রাস্তে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর মতো অত বড়ো বিচ্ছেদকে, প্ৰাণ যাকে পরম শত্রু বলে জানে, তাকেও তিনি পরিপূর্ণ করে দেখতে পেয়েছেন। তাই আমাকে গাইতে অনুরোধ করেছিলেন আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে, তবুও শাস্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে। নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যালেশ, সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে৷ যে গানটি তিনি আমাকে দুবার অনুরোধ করে শুনলেন সেটি এই ;