পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ԳԵ রবীন্দ্র-রচনাবলী অমৃতঅন্ন। সেই দান সেই অমৃত পিয়ার্সন যদি এই আশ্রমে দিয়ে গিয়ে থাকেন তবে আমরা যেন তা সত্যভাবে গ্রহণ করবার শক্তি রাখি। তার দানের থেকে আমরা তার বাহিরের মূল্যটুকু নেব। না কিন্তু তার অস্তরের সত্যটুকু নিই। নইলে ভিক্ষুকতার যে ব্যর্থতা ও লজ্জা তার থেকে আমাদের পরিত্রাণ নেই। সেই সত্যটি কী ভেবে দেখা যাক। পিয়র্সন ছিলেন ইংরেজ, কিন্তু ভারতবর্ষে সম্পূর্ণভাবে তিনি তীর জীবন উৎসর্গ করতে পেরেছিলেন। তার দুঃখে অপমানে ব্যথিত হয়ে তিনি নিজের জাতিকে নিন্দা বা আঘাত করতে লেশমাত্র কুষ্ঠিত হন নি। যাকে আমরা আজকাল দেশাত্মবোধ নাম দিয়েছি সেই দেশাত্মবোধকেই তিনি সকলের চেয়ে বড়ো মৰ্যদা দেন নি। এমন-কি একদা তিনি ভারতের হিত কামনায় সেই দেশাত্মবোধকে এমন আঘাত করেছিলেন যে তার দেশের রাজদণ্ড তাকে চীন থেকে তাড়া করে নিয়ে ইংলন্ডে নজরবন্দী করে রেখেছিল। প্রবল দেশাত্মবোধ নিয়ে কোনো ইংরেজ কখনাে আমাদের কিছু দান করেন না তা নয়, কিন্তু সে দান তার উদ্যুবৃত্ত থেকে। দেশাত্মবোধের ভোজের যে পরিশিষ্ট অনায়াসে দেওয়া যায়। তাই। করেন নি- তিনি তীর আত্মাকেই দিয়েছিলেন আমাদের, এবং সেই উপলক্ষে সমস্ত মানুষকে, সমস্ত মানুষের দেবতাকে। আমি তাকে দেশ-বিদেশে নানা অবস্থায় দেখেছি- চীনে হােক জাপানে হােক অন্যত্র হােক যেখানেই তিনি দুঃখ বা অপমান দেখেছেন এবং এও অনুভব করেছেন যে, সেই দুঃখ অপমানের মূলে আছে তার স্বজাতি— সেখানে তিনি মুহুর্তকালের জন্য এবং লেশমাত্র পরিমাণেও স্বদেশের রাষ্ট্ৰীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করেন নি। তিনি জানতেন যে ইংলন্ডের সভ্যতা ও উন্নতি এশিয়া ও আফ্রিকার প্রাণ পোষণের উপর একান্ত নির্ভর করে, তার ধনসম্পদ প্ৰতাপের চারণক্ষেত্র এই সকল মহাদেশে, তৎসত্ত্বেও তিনি তঁর শুভচিন্তা ও সাধু লক্ষ্য বিশুদ্ধভাবে, নিঃস্বার্থভাবে ও সম্পূর্ণভাবে সর্বমানবের অভিমুখে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু যখন পিয়র্সনকে আমরা ভারতবন্ধু বলে আদর করি তখন তাঁর জীবনের এই বড়ো সত্যটিকে এক রকম করে চাপা দিয়ে রাখি। তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যেখানে আমাদের স্বােজাত্য অভিমানকে তৃপ্ত করে সেইখানেই তাকে যথার্থভাবে গ্রহণ করি ক্ষণকালের জন্যে চিস্তাও করি নি যে এই স্বােজাত্য অভিমানকে জলাঞ্জলি দিয়ে তবে তিনি আমাদের কাছে এসেছেন, এবং সেই মহিমাতেই তার জীবন দীপ্যমান। যদি তার এই সত্যকে আমরা শ্রদ্ধা না করি। তবে তার হাত থেকে দান গ্রহণ করবার মতো দীনতা আর কিছু হতেই পারে না। তঁকে বহিষ্কৃত করে তীর দান গ্রহণ করায় তীর প্রতি ও নিজের প্রতি যে অশ্রদ্ধ করা হয় সেটা যেন আমরা অনুভব করতে পারি। সেই বড়ো সত্যকে স্বীকার করবার জন্য বিশ্বভারতীর সাধনা। যারা বিশ্বের জন্য তপস্যা করেছেন। এখানে তাদের আসন পাতা হােক। আমরা "বন্দেমাতরম' বলে জয়ধ্বনি করলে কেবল স্বদেশকে ক্ষুদ্র করা হবে, আমরা এই কার্পণ্যের দ্বারা বড়ো হতে পারব না। মানবপ্রেমের অর্ঘ্য হৃদয়ে বহন করে সমুদ্রপার থেকে যে বন্ধুরা আমাদের কাছে আসছেন তাদের জীবন বিশ্বভারতীর তপস্যার ভিতর দিয়ে এই কথাই ঘোষণা করছে যে, সকল মানুষের মধ্যে নিজের মনুষ্যত্বকে উপলব্ধি করা মানব সম্বন্ধে সত্যকে পাওয়া। পিয়ার্সন ভারতবর্ষে এসে শুধু যে এর দুঃখকষ্ট অপূর্ণতার মধ্যে একে সেবা করে গেছেন তাই নয়। কিন্তু তিনি এখানকার জীবনযাত্রার প্রণালীকে স্বীকার করে নিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে আনন্দে বলেছেন, আমি যা পেলুম তা খুব বড়ো জিনিস, আমি কৃতাৰ্থ হলুম। তা বলবার আসল কারণ এই যে তিনি আপনাকে দিতে গিয়েই বড়ো সম্পদ লাভ করেছেন। আমরা যখন কেবলমাত্র পেতে যাই তখন বড়োকে পাই নে, যখন নিতে যাই তখন ভূমীকে পাই। ভারতবর্যের উপকার করব বলে যদি কেউ কোমর বেঁধে আসে তা হলে ভারতবর্ষকে যথার্থ